কানহাইয়ারা আর আসবে না?
২৩ এপ্রিল ২০১৭নতুন দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) স্বায়ত্তশাসন নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে৷ ইউজিসি-র নতুন শিক্ষানীতি-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে আবারও আন্দোলন দানা বেঁধেছে ঐতিহ্যময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত৷
বিগত কয়েক দশক ধরেই জেএনইউ বামপন্থিদের আঁতুড় ঘর হিসেবে পরিচিত৷ মুক্তচিন্তা, স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং প্রতিবাদের অধিকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মজ্জাগত ব্যাপার৷ কিন্তু পরিস্থিতি চীরকাল যে একরকম থাকে না, তা বোঝা গেল ২০১৪ সালে ভারতের শাসনভার ভারতীয় জনতা পার্টির হাতে যাওয়ার পর৷ কখনও কানহাইয়া কুমার, কখনও ওমর খালিদের বিতর্কিত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত গোটা দেশের বুদ্ধিজীবীরা৷ আবার কখনও বা শুধুমাত্র ‘এক ধর্মের দেশ' গড়ার ব্রতীদের হাতে বেদম মার খাওয়ার পর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেলেন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মুসলিম ছাত্র৷ এইসব তো চলছিলই৷ আর তলে তলে হিসেব-নিকেষ করে নিচ্ছিলেন কেউ বা কারা৷
পরিকল্পনা যারা করছিলেন, তাদের মগজে ছিল একটাই চিন্তা – ‘ভবিষ্যতের কানহাইয়া কুমারদের কণ্ঠরোধ করতে হলে হাতে নয়, ভাতে মারতে হবে৷' তাই তো প্রশ্ন উঠেছে, গবেষণা ক্ষেত্রে এমন বিপুল সংখ্যক আসন কাটছাঁটের পেছনে যুক্তি কী? উত্তর দেওয়ার অবশ্য কেউ নেই৷
আদালতে ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ইউজিসি-র নতুন শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল ক'দিন আগে৷ বিচারক সেই আবেদন খারিজ করে দেয়৷ শিক্ষার্থীকা তাই এবার দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ দু'দিন আগেই হাইকোর্ট পুরো বিষয়টিতে জেএনইউ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চেয়ে নোটিশ পাঠায়৷ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি গীতা মিত্তল এবং বিচারপতি অনু মলহোত্রার ডিভিশন বেঞ্চ ২৮ এপ্রিলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হলফনামা দিয়ে নিজেদের বক্ত জানানোর নির্দেশ দিয়েছে৷ সেদিনই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে৷
গতবছর ডিসেম্বরে জেএনএউ অ্যাকাডেমিক পরিষদের বৈঠকে গৃহিত সিদ্ধান্ত এবং গত মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রকাশিত ই-প্রসপেক্টাসের মধ্যে বিস্তর ফারাক পাওয়া গেছে৷ ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের জন্য জেএনইউ অ্যাকাডেমিক পরিষদ ১৪০৮ জন গবেষক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ কিন্তু ২১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে জারি করা ই-প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে শুধুমাত্র ২৪২ জন ছাত্রছাত্রী গবেষণার সুযোগ পাবেন৷ অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক পরিষদের সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসন সংখ্যায় ৮২. দশমিক ৮১ শতাংশ আসন কমিয়ে দিয়েছে৷ এর ফলে জেএনইউ-এর ৩১টি কেন্দ্র এবং দু'টি বিশেষ কেন্দ্রে একজনও গবেষক ছাত্র ভর্তির সুযোগ পাবেন না৷ পুরো বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের একটা অংশ৷
কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাওড়েকরকে চিঠি লিখে সমস্যার সমাধান চেয়েছেন নির্বাচিত বামপন্থি ছাত্র সংসদের সভাপতি মোহিত কুমার পান্ডে৷ তিনি জানতে চেয়েছেন, ২০১৭ সালে কেন্দ্র সরকারের র্যাংকিং অনুযায়ী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে৷ তারপরেও কীসের ভিত্তিতে গবেষণার শিখরে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা তলানিতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? জাওড়েকর অবশ্য এখনও চিঠির জবাব দেননি৷ এমনকি প্রকাশ্যে তেমন কোনো মন্তব্যও করেননি৷ তবে ইউজিসি কার্যালয়ের বাইরে ধর্ণা, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলেছেন ছাত্র-ছাত্রীরা৷
মোহিত কুমার জানিয়েছেন, ‘‘ই-মেলে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত সংস্থার শীর্ষে রয়েছেন আপনি৷ প্রকাশ্যে উচ্চ র্যাংকিং-এর সংস্থাগুলিকে আরও বেশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলছেন৷ কিন্তু কাজের নিরিখে তার কোনো প্রমাণ মিলছে না৷ একদিকে, ইউজিসি-র ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী জেএনইউ-এর আর্থিক অবস্থা শোচনীয়৷ গবেষণা ক্ষেত্রের আসন সংখ্যা এবং বরাদ্দ যে কাটছাঁট করা হয়েছে, তা মোটেও স্বাভাবিক নয়৷ অস্বাভাবিক এই সিদ্ধান্তের প্রকৃত কারণ কী?''
মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে মোহিত আরও লিখেছেন, ‘‘আপনি বার বার ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলান করেন৷ কিন্তু পরিস্থিতি হলো, এ দেশে ছাত্র-শিক্ষকের আনুপাতিক হার সঠিক না হওয়ার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান ক্রমশই কমছে৷'' জেএনইউ-তে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গটিও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মোহিত৷ জানিয়েছেন, ‘‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু শিক্ষকের পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে৷ সেগুলো পূরণ করার কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না৷ উপাচার্য, ইউজিসি কর্তৃপক্ষ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা বলে চুপ করে বসে আছে৷''
ইউজিসি কর্তৃপক্ষ জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের মোট ১১ কোটি টাকার নন-নেট ফলোশিপ আটকে রেখেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ ফেলোশিপ বরাদ্দ না হওয়ায় গবেষণারত ছাত্র-ছাত্রীরা সমস্যায় পড়েছেন৷ জেএনইউ-এর রেজিস্ট্রার প্রমোদ কুমারের কথায়, ‘‘উপাচার্য এম জগদীশ কুমার এই বিষয়ে বার বার ইউজিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ কিন্তু কোনো লাভ হয়নি৷'' উল্লেখ্য, ইউজিসি-র কাছ থেকে প্রাপ্য নন-নেট ফেলোশিপের এই অর্থ সাধারণত এমফিল এবং পিএইচডি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়৷
আসন সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া এবং বরাদ্দ অর্থ আটকে রাখার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে দিল্লিতে আসা তপশিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রী চরম সমস্যার সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন ছাত্র সংগঠনগুলি৷
এ বিষয়ে সম্প্রতি সংসদের রাজ্যসভায় বিহারের জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর প্রবীন সাংসদ শারদ যাদবের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী প্রকাশ জাওড়েকর অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর সরকার জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে আছে৷ ইউজিসি নোটিফিকেশন-২০১৬ ইতিমধ্যে দেশের অন্যান্য সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে৷ এতদিন জেএনইউ-তে চালু হয়নি৷ তাই এবার সেটা চালু হবে৷ তবে এর ফলে এমফিল ও পিএইচডি-র আসন সংখ্যায় কোনো কাটছাঁট হবে না৷ শিক্ষার মান বৃদ্ধি সরকারের লক্ষ্য৷ সেই লক্ষ্যেই ইউজিসি নিয়মিত নোটিফিকেশন জারি করে থাকে৷ এই নোটিফিকেশনে এমফিল এবং পিএইচডি পাঠ্যক্রমে ভর্তি পরীক্ষা চালুর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এবং গবেষণক ছাত্র ও তাঁদের গাইডের আনুপাতিক হার সঠিকভাবে বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে৷''
মন্ত্রীর আশ্বাস, ‘‘গত বছর ৯৭০ জন ছাত্র-ছাত্রী গবেষণায় ভর্তি হয়েছিলেন৷ এবার নতুন ব্যবস্থা ও শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ করার পর সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে৷''
প্রতিবেদনটি নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷