1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে দ্রুত ধোঁয়াশা কাটুক

৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক মাস অতিবাহিত হয়েছে৷ কেউ এই ঘটনাকে গণঅভ্যুত্থান বলছেন, কেউ বলছেন বিপ্লব৷ এই এক মাস পর আমরা কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে?

https://p.dw.com/p/4kNT2
ছাত্র-জনাতার আন্দোলন৷
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা৷ ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images

বিপ্লব বলতে আমাদের পেছনে শতশত উদাহরণ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লব, ১৯৪৯ সালের চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লব, ১৯৭৯ সালের ইরানের ইসলামিক বিপ্লব ইত্যাদি। এর প্রতিটিতেই পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার বিনির্মাণ ঘটেছে৷

আক্ষরিক এই বিশ্লেষণ থেকে সহজেই বলা যায়, বাংলাদেশে সরকার বদলের আন্দোলনটি স্বৈরাচারী-কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলের বিপ্লব নয়৷ আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নানা বক্তব্যেও এটা স্পষ্ট যে, তারা আমূল পরিবর্তন নয়, বরং যথাসম্ভব রাষ্ট্রসংস্কারে আগ্রহী৷

এখন পর্যন্ত যেসব সংস্কার বাস্তবায়ন হতে আমরা দেখেছি সেগুলো হচ্ছে ব্যক্তিপর্যায়ের রদবদল৷ অর্থাৎ, কাউকে বাদ দেয়া, নতুন কাউকে দায়িত্ব দেয়া, কাউকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া, কাউকে জেলে ঢোকানো৷ এই প্রক্রিয়া আমরা ক্ষমতার পালাবদলে বরাবরই দেখে এসেছি৷ নীতিতে কিছু পরিবর্তন আমরা দেখেছি শিক্ষা কারিকুলামের ক্ষেত্রে৷ এটাও নতুন কিছু নয়, বরং নতুন সরকার দায়িত্ব নিলেই শিক্ষা দিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা শুরু করার উদাহরণ অতীতে অজস্র রয়েছে৷

ফলে রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল সংস্কারের বিষয়টি এখনও এত স্পষ্ট হয়ে উঠে আসেনি৷ হয়তো আরেকটু সময় গেলে এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে৷

সংস্কারের বিষয়টির পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে৷ এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ৷ এই বাংলাদেশে বিভক্তির বদলে ঐক্য়ের ডাক দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু তার রূপরেখা কেমন হবে, কী কী থাকবে এই অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশে, তার ধারণা এখনো স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়নি৷

বাংলাদেশের সমাজ নানা ইস্যুতে প্রচণ্ড মাত্রায় বিভক্ত৷ সেই বিভক্তিকে কিভাবে একসূত্রে গাঁথা যাবে এবং ঐক্য কোন প্রক্রিয়ায় মজবুত করা হবে, সেটিই মূল প্রশ্ন৷ কিছু ইস্যুতে অস্পষ্টতার আলোচনা করাই যায়। এই অস্পষ্টতা দূর না করলে বিভক্তি কমার বদলে বরং আরো গভীরে প্রোথিত হতে পারে৷

সংবিধান নিয়ে অস্পষ্টতা

অভ্যুত্থান বা বিপ্লব, যাই ঘটুক না কেন, সেটা সংবিধান বা আইন মেনে হয় না৷ অনেকের কাছে শুনতে খারাপ লাগলেও, এটাই সত্যি৷ বরং আইন এবং আইনের প্রয়োগকারীরা যখন জনগণের বদলে শাসকদের স্বার্থ হাসিলে কাজে লাগে, তখন সেই আইনের বিরুদ্ধেই মানুষ রুখে দাঁড়ায়৷

কিন্তু এখন সংবিধানের গুরুত্ব কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। বর্তমান সংবিধানের অধীনেই শপথ নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ৷ এই সরকার যে বৈধ, সেটা আপিল বিভাগের কাছ থেকে রুল নেয়া হয়েছে ৮ আগস্ট উপদেষ্টারা শপথ নেয়ার আগেই৷ কিন্তু তারপর আবার প্রধান বিচারপতিসহ সেই আপিল বিভাগের সদস্যদেরই পদত্যাগ করতে হয়েছে আন্দোলনের মুখে৷ আইন বিষয়ক উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, সজীব ভুঁইয়াও প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপ দিয়েছেন৷ ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতিকে 'ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট’ বলেও উল্লেখ করেছেন৷

‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চলবে’

সাধারণ পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের যে-কোনো হস্তক্ষেপ নিন্দনীয়৷ কিন্তু স্বাধীন বিচারবিভাগ বাংলাদেশে বরাবরই 'কাজীর গরু' হয়েই থেকেছে, যার অস্তিত্ব কেতাবে থাকলেও বাস্তবে ছিল না৷ আমরা অন্য অনেক উদাহরণের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতিকে শাসক দলের বিরুদ্ধে যাওয়ায় দেশছাড়া হতেও দেখেছি৷ সেক্ষেত্রেও কোনো আইনি প্রক্রিয়া বা স্বাভাবিক চক্ষুলজ্জারও ধার ধারেনি তৎকালীন সরকার৷

কিন্তু আগেই বলেছি, অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর সবকিছু আইন মেনে কখনোই হয় না৷ কিন্তু সেক্ষেত্রেও স্পষ্ট ঘোষণা প্রয়োজন৷ পরবর্তীতে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, আপিল বিভাগ সরকারকে বৈধ বলে রায় দিলো, সেই আপিল বিভাগকেই যদি 'ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট’ বলে খারিজ করে দেয়া হয়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়?

সংবিধান চাইলেই সংস্কার বা পরিবর্তন, নতুন করে লেখা বা যে-কোনো কিছুই করা সম্ভব৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই সংবিধানের আলোকেই অতীতে দুইটি সামরিক শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল৷ ফলে পরবর্তী যে-কোনো নির্বাচিত সরকারের পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তাদেরও সংবিধান আবার বদলে নিজেদের মতো করে নেয়ার সুযোগ থাকবেই৷

সাংবিধানিক কাঠামো মেনেই কিন্তু এখনো আওয়ামী লীগের নিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকেই রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাখা হয়েছে৷ যদিও কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করে প্রধান উপদেষ্টাকেই 'বিপ্লবী সরকারের’ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷

সংবিধান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা শোনা যাচ্ছে৷ কেউ সংস্কার চাইছেন, যাতে পরবর্তীতে আর কোনো সরকার কর্তৃত্ববাদী না হয়ে উঠতে পারে, যাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাবলে কেউ সর্বেসর্বা না হয়ে উঠতে পারে৷ কিন্তু এখনো ঠিক কোন কোন অনুচ্ছেদের সংস্কার হবে, নাকি পুরো সংবিধানই নতুন করে লেখা হবে, এ নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আসেনি৷

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য বারবারই বলছেন যে, সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই এ বিষয়টি ঠিক করা হবে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা যে শুরু হয়েছে, সেটাও দেখা যাচ্ছে৷

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক মাহফুজ আলম এক সংলাপে এ নিয়ে বক্তব্য স্পষ্ট করেছেন৷ 'নতুন জনগণের আকাঙ্খা’ এই সরকারের ভিত্তি এবং তার ওপর নির্ভর করেই সরকারের বাকি পদক্ষেপ নির্ভর করবে বলে মত দিয়েছেন তিনি৷ তবে তিনি এ-ও বলেছেন যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে৷

কিন্তু সেটাও স্পষ্ট না যে, জনগণের আদর্শিক আকাঙ্খাটা আসলে কী, বা নির্বাচন-গণভোট ছাড়া সেটা জানার উপায়ই বা কী!

মাহফুজ আলম বলেছেন, ১৯৭১ সালের জনগণের আকাঙ্খা এবং ২০২৪-এর জনগণের আকাঙ্খার পার্থক্যটা ধরতে হবে, একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের আকাঙ্খার ধারাবাহিকতাও রক্ষা করতে হবে৷ কিন্তু '৭১ এবং '২৪-এর আকাঙ্খার তফাৎটা আসলে কী! মোটা দাগে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার আকাঙ্খা তখনো ছিল, এখনো আছে, মানুষের মতো ও ভাব প্রকাশের আকাঙ্খা তখনো ছিল, এখনো আছে। আকাঙ্খার পার্থক্যটা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ না করতে পারলে সেটা দূর করাও সম্ভব হবে না৷

মাহফুজ আলম যথার্থই বলেছেন, আদর্শিক, রাজনৈতিক তর্কগুলোকে মীমাংসার দিকে নিয়ে না যেতে পারলে সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন করা হোক, সেটা জনগণের কাছে টিকে থাকবে না৷ এখন দেখার বিষয় এত বিশাল কর্মযজ্ঞ অন্তর্বর্তী সরকার কিভাবে করে!

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে৷
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জামায়াত

অনেকেই জুলাই অভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা আখ্যা দিয়েছেন, কেউ কেউ বলছেন স্বাধীনতা ১৯৭১ সালেই হয়েছিল, সেটাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ তবে তর্কটা আসলে ভাষার ব্যবহার নিয়ে নয়, বরং আদর্শের ব্যাখ্যা নিয়ে৷

একটা নির্দিষ্ট দলের বিপক্ষে গেলেই আগে যেমন 'রাজাকার’ আখ্যা দেয়ার মানসিকতা দেখেছি, এখন অনেক ক্ষেত্রেই সে জায়গা নিয়েছে 'ফ্যাসিবাদের দোসর', 'আওয়ামী লীগের দালাল’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ৷

যে-কোনো আন্দোলন, বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থানে জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ না থাকলে সেটা সাফল্য লাভ করে না৷ কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা দেখি আন্দোলন সফল হওয়ার পর সেটার নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও আদর্শিক দখলদারিত্ব৷

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থাকলেও সেখানে অন্য নানা রাজনৈতিক দল এবং অরাজনৈতিক পক্ষের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ছিল৷ আর সেকারণেই সেটা আওয়ামী লীগের দেশ ভাঙার ষড়যন্ত্র না হয়ে পরিণত হয়েছিল একটা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে৷

কিন্তু এরপর থেকে এত বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের ওপর দলটির একক দখলদারিত্ব আমরা কায়েম হতে দেখেছি৷ সেটাও আওয়ামী লীগের দায় যতটা, অন্যদের দায়টাও আমি কম দেখি না৷ আওয়ামী লীগ যতটা মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের একক বিপ্লব হিসাবে দাবি করেছে, অন্যরা নিজেদের দখল ছেড়ে দিয়ে সেটা আওয়ামী লীগের সহায়তাই করেছে৷ একই ঘটনা ঘটেছে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও৷ একজন জাতীয় নেতাকে সর্বেসর্বা বানাতে গিয়ে অন্য সব জাতীয় নেতাকে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ আওয়ামী লীগ যত চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের নেতা বানাতে, তত তিনি জাতির নেতা থেকে বেশি আওয়ামী লীগের নেতায় পরিণত হয়েছেন৷

বাংলাদেশের পতাকা মাথায় নিয়েই কিন্তু আন্দোলনকারীরা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে৷ ফলে এই পতাকা এনে দেয়ার পেছনের কারিগর যারা, তাদের যত দূরে ঠেলে দেয়া হবে, আড়ালে ঠেলে দেয়া হবে, ততই বিভক্তি আরো বাড়বে৷

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা, জাতীয় সংগীত নিয়ে একটা পক্ষ থেকে অনেক আগের চাপা পড়া প্রশ্ন আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব উপস্থিতি জানাচ্ছে৷ এ নিয়েও যৌক্তিক আলোচনা ও মীমাংসার প্রয়োজন রয়েছে৷

আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা দল জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে নানা কর্মসূচি দিচ্ছে৷ মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অপরাধে সহায়তার যেসব অভিযোগ দলটির বিরুদ্ধে রয়েছে, এরও কোনো স্থায়ী মীমাংসা হয়নি, জামায়াতে ইসলামী কখনোই স্বাধীন জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি৷

সবকিছুর পাশাপাশি এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কী, সেটা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা৷ একদিকে তার ভাস্কর্য ভাংচুর করা হয়েছে, ১৫ আগস্ট শোক দিবসের ছুটি বাতিল করা হলেও শোক দিবস বাতিল করা হয়নি৷ কিন্তু আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালনও করা হয়নি, যারা শোক পালনে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে গিয়েছিলেন, তাদের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে৷ একদিকে, আন্দোলনকারীদের সমন্বয়কদের কারো কারো মুখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ‘‘১৫ আগস্ট মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল’’- এমন বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, অন্যদিকে কোনো কোনো উপদেষ্টার কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি এখনো টানানো দেখা যাচ্ছে৷

কেউই আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে না৷ বঙ্গবন্ধুকে এই আলোচনার বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেই বরং তার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা তিনি, এটা খারিজ করার কোনো উপায় নেই৷ কিন্তু এর মানে আর কোনো নেতা ছিলেন না, মাওলানা ভাসানী বা তাজউদ্দিন আহমদের মতো নেতাদের কোনো অবস্থান থাকবে না, এটাই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে৷

এতদিন বঙ্গবন্ধুর সমালোচনামূলক যেকোনো মন্তব্যকেই কটূক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হতো৷ ফলে স্বাভাবিক আলোচনার পথও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু এখনও যদি স্বাভাবিক আলোচনার পথ রুদ্ধ করে সেই ইতিহাসকেই নাই করে দেয়া হয়, সেটাও আত্মঘাতীই হবে৷

বাকশাল, রক্ষী বাহিনী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা সরকার বদলালেই বদলে যায়৷ ফলে নির্মোহ আলোচনার পরিবেশ কখনোই তৈরি হয়নি৷

কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আনোয়ার উল আলম রচিত 'রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা' বইটি ২০১৩ সালেই প্রকাশিত হয়৷ সেখানে বাকশাল নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় সরোয়ার ও আমি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর অতিথিদের আসনে বসেছিলাম৷ কণ্ঠভোটে সংশোধনীটি পাস করার সময় সরোয়ার বলে উঠল, 'বঙ্গবন্ধু আজ গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরলেন’৷

এমন নানা আলোচনা, যাতে নির্মোহভাবে করার সুযোগ থাকে, সে পরিবেশটা তৈরিও আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং উপদেষ্টাদেরই দায়িত্ব৷ ইতিহাস বদলে দেয়াটা কোনো কাজের কথা না৷

ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ

সংবিধান নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা আবার উঠে এসেছে৷ কেউ দাবি করছেন সেক্যুলার এক বাংলাদেশের যেখানে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে৷ আবার সেটার বিপরীতে ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের আহ্বান এসেছে৷ তবে এই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে কী কী অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং ভিন্ন ভিন্ন আদর্শকে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সে ব্যাপারে এখনও আলোচনা শুরু হয়নি৷ ফলে এ নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা৷

সংবিধানের অন্যান্য নানা অংশের মতো ধর্মনিরপেক্ষতা অংশটুকু বেশ কাটাছেঁড়া হয়েছে৷

আন্দোলনের সমন্বয়ক ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের আদর্শে ১৯৭১ ছিল ‘ইতিহাসের শেষ অধ্যায়’৷ কিন্তু আমরা মনে করি, এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা৷ ১৯৪৭ বা পাকিস্তান আন্দোলন ছাড়া বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হতো না৷ আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ৭১ এর প্রশ্নটিকে সমাধান করতে চাই৷’’

১৯৪৭ ছাড়া ১৯৭১ আসতো না এবং বাংলাদেশ আসলে নানা আন্দোলনের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, কথাটা খুবই যৌক্তিক৷ এখানে আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে৷ ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়৷ কিন্তু এই দ্বিজাতি তত্ত্ব যে ভুল ছিল ১৯৭১ সালে ধর্মের বদলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার লড়াইয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াটাই এর সুস্পষ্ট প্রমাণ৷

কিন্তু এই জাতীয়তার সমাধান কি ১৯৭১ সালেই হয়ে গেছে? তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশ আলাদা হয়েছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেই একই ঘটনা যাতে নতুন দেশে না ঘটে, তার দায়িত্ব ছিল নতুন দেশের রাজনীতিবিদদের৷ পাকিস্তানে যেমন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ধাক্কা খেয়েছিল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ধাক্কা খেয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ৷

১৯৪৭-এর পর আমরা বুঝতে শুরু করেছি, শুধু ধর্ম বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কাঠামো মজবুত হতে পারে না৷ ১৯৭১ এর পর আমরা শিখতে শুরু করেছি, কেবল ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রও সবাইকে সমানভাবে ধারণ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম না৷ এই দুই অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে সামনে এগোতে না পারলে আমরা কি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ তৈরি করতে পারবো?

এখনও আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখতে পাই, যেটা সমতলের সেনাবাহিনীর উপস্থিতির চেয়ে আলাদা৷ এখনও আমরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা দেখতে পাই, মাজারে হামলা দেখতে পাই, তিন বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা দেখতে পাই৷ ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও এমন উপাদানের উপস্থিতি আমরা অতীতেও দেখেছি৷ এর সুষ্ঠু সমাধান না হলে কি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

অন্তর্বর্তী সরকার কী কী করবে সেটা নিজেরা ঠিক করে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না, বরং অন্যদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে তারপর এজেন্ডা ঠিক করতে চাচ্ছে৷ এটা একটা ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি৷ এক মাস হয়তো এত বড় কর্মযজ্ঞের জন্য খুবই ক্ষুদ্র সময়৷ কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, দ্রুত একটা রোডম্যাপ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে হাজির না করলে নানা পক্ষের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিরোধের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হবে৷

নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং আদর্শের বিরোধ এখন গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ এজেন্ডা ও রোডম্যাপ স্পষ্ট করতে খুব দেরি হয়ে গেলে সেটা আরো জটিল আকার ধারণ করার শঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান