ফাঁসি রদ নিয়ে বিতর্ক
২২ জানুয়ারি ২০১৪সুপ্রিম কোর্টের অতি সাম্প্রতিক এক ঐতিহাসিক রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে৷ ফাসির আসামিদের মার্জনা ভিক্ষার আবেদনে সরকার বা রাষ্ট্রপতি যদি সিদ্ধান্ত না নিয়ে দীর্ঘকাল ঝুলিয়ে রাখেন, সেক্ষেত্রে ফাঁসির আদেশ পরিবর্তিত হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে৷ এই রায় অবিলম্বে প্রযোজ্য হবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ১৫ জন আসামির ক্ষেত্রে৷ এদের মধ্যে চারজন কুখ্যাত জঙ্গল দস্যু বীরাপ্পনের সহচর৷ শীর্ষ আদালতের যুক্তি, ফাঁসির সাজা মাথায় নিয়ে দীর্ঘকাল জেলের নির্জন সেলে বন্দি জীবনযাপনে মানসিক যন্ত্রণা ও কষ্ট সহ্য করতে করতে তাঁরা হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য৷ সেখানে ফাঁসি অর্থহীন৷
এই রায়ের প্রেক্ষিতে অনেক ফাঁসির আসামি একটা আশার আলো দেখতে পারছে৷ ৮০-এর দশকে পাঞ্জাবে খালিস্তানি সন্ত্রাসী দেবিন্দর পাল ভুল্লারকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট স্বয়ং৷ দেবিন্দরের পক্ষে রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা ভিক্ষার আবেদন জানানো হয়৷ কিন্তু সেই আবেদন পড়েই থাকে৷ মনোচিকিৎসকরা মনে করেন, দীর্ঘদিন জেলের নির্জন সেলে বন্দি থেকে সে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এই বিলম্বের কারণে৷ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির হত্যাকারীদের তিনজনকে ফাঁসির সাজা দেয়া হলে তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানায়৷ তা খারিজ হোয়ে গেলে তাকে চ্যালেঞ্জ করে তিন বছর আগে তারা আবার আদালতে যায়৷ এখনো পুনর্বিবেচনার আর্জির ফয়সালা হয়নি৷ শুনানি হবার কথা এ মাসে৷
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চের রায়ে এই নির্দেশও দেয়া হয় যে, প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ হয়ে গেলে আসামিকে ও আসামির নিকট পরিজনদের তা সময়মত জানাতে হবে এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে জেল কর্তৃপক্ষকে৷ শুধু তাই নয়, ফাঁসির আসামিকে নির্জন সেলে রাখাটাও অসাংবিধানিক বলে মনে করে শীর্ষ আদালত৷
প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ হবার পর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে হবে ১৪ দিনের মধ্যে৷ উল্লেখ্য, সংসদে সন্ত্রাসী হামলার অপরাধী মহম্মদ আফজল গুরুর ফাঁসি হয় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার অপরাধী আজমল কাসবের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১২ সালে৷ উভয়ক্ষেত্রে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয় তাদের পরিবারকে আগাম না জানিয়ে, এই রকম একটা অভিযোগ উঠেছিল৷ ২০০৪ সালে কলকাতার ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ১৩ বছর নির্জন সেলে বন্দি রাখার পর ফাঁসি দেয়া হয়৷
ফাঁসির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা৷ ফাঁসি রদ করার বিষয়ে আন্দোলনে নেমেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলি৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ফাঁসির শাস্তি তুলে দেবার পক্ষে ৬৫ হাজার গণস্বাক্ষর সম্বলিত এক স্মারকলিপি তুলে দেয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে৷ তাদের মতে, মৃত্যুদণ্ড অমানবিক, একতরফা এবং পক্ষপাতদুষ্ট৷ টাকার এবং প্রভাব প্রতিপত্তির অভাবে অনেক সময় গরিব শ্রেণির যেখানে ফাঁসি হয়, সেখানে একই ধরণের অপরাধে ধনীরদের হয় যাবজ্জীবন৷ ‘‘বিরলতম বিরল'' ক্ষেত্রে ফাঁসি দিয়েও সমাজে জঘন্যতম অপরাধ দমন করা যায়নি৷ এক জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে সমাজের ৪০ শতাংশ ফাঁসি রদ করার পক্ষে এবং ৩০ শতাংশ এর বিপক্ষে আর ৩০ শতাংশ কোনোটাই নয়৷ জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর রেকর্ড অনুসারে, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৪৫৫ জন ফাঁসির আসামি মৃত্যুর দিন গুনছে ভারতের বিভিন্ন জেলে৷ সংখ্যাটা সম্ভবত আরো বেশি হতে পারে৷