যাদুঘরের ২০০ বছর পূর্তি
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দিল্লি থেকে এক বেলার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন স্রেফ ভারতীয় যাদুঘরের দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে৷ ভারতের খুব কম প্রতিষ্ঠানই এমন গুরুত্ব দাবি করতে পারে, যা প্রাপ্য কলকাতার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের৷ ২০০ বছর পূর্তি উৎসব পালনের যোগ্য মঞ্চ করে তুলতে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকেই মেরামতি, সংস্কার ও পুনর্বিন্যাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল জাতীয় যাদুঘর৷ পরের পাঁচ মাসে আগাপাশতলা ঝাড়াই-পোঁছাই, বা গ্যালারিগুলিতে নতুন রঙের পোঁচ, আলোর ব্যবস্থা আরও ভাল করা ছাড়াও বেশ কিছু গ্যালারি নতুন করে সাজানো হয়েছে৷ তাদের লে-আউট বদলেছে, দ্রষ্টব্য বস্তুগুলিরও রদবদল হয়েছে৷ সব মিলিয়ে এক নতুন চেহারায় এবং নতুন সাজে ফের দরজা খুলেছে ভারতীয় যাদুঘরের৷
কিন্তু এতেই কি সন্তুষ্ট থাকা উচিত নাগরিকদের, যাঁরা সত্যিই মনে করেন ভারতের এবং গোটা এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বৃহত্তম এই সংগ্রহশালা গোটা উপমহাদেশের গর্বের উত্তরাধিকার? সম্ভবত না৷ কেন নয়, সে কথা বলে গেলেন এই দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, দেশের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং৷ যদিও এটাও খুব নজর করার মতো যে পরদিন বিভিন্ন খবরের কাগজে এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এটাই শিরোনাম হল যে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কলকাতার ভারতীয় যাদুঘর যেন পর্যটকদের অবশ্য-গন্তব্য হয়ে ওঠে৷ প্রধানমন্ত্রী কি এ কথা বলেননি তাঁর ভাষণে? অবশ্যই বলেছেন, কিন্তু তিনি তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু বলেছেন, যা আগামীদিনে ভারতীয় যাদুঘর এবং দেশের অন্যান্য সমস্ত যাদুঘরের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠা উচিত৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই দরকারি কথাটা অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্য গুরুত্ব পায়নি৷
ঠিক কী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং? বলেছেন, যাদুঘর যেন শিল্প ও প্রত্নসামগ্রী মজুত রাখার জায়গা হয়েই না থেকে যায়৷ ‘নট আ প্লেস টু স্টোর আর্টিফ্যাক্টস'৷ যেন গুদামঘরে পরিণত না হয় যাদুঘর৷ তা হলে কী করণীয়? প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিশ্বের সব বড় যাদুঘর যে বৃহত্তর আদর্শ এবং লক্ষ্য নিয়ে পথ চলে, ভারতীয় যাদুঘরেরও সেটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ অর্থাৎ জ্ঞান আহরণের, জ্ঞান বিতরণের জায়গা হয়ে উঠুক যাদুঘর৷ যাদুঘর পরিণত হোক ‘ইনস্টিটিউশন অফ লার্নিং'-য়ে, বলেছেন মনমোহন সিং৷ অর্থাৎ, অনুসন্ধিৎসু গবেষক বা ছাত্র-ছাত্রীরা যে মনোভাব নিয়ে লাইব্রেরিতে যায়, বা উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, লোকে সেভাবেই যাদুঘরেও আসুক, শিখতে, জানতে৷
আসলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ডক্টরেট, প্রগাঢ় পণ্ডিত এবং বহুদর্শী মনমোহন সিং নিশ্চিতভাবেই ইউরোপ এবং আমেরিকার বিখ্যাত সংগ্রহশালাগুলির কথা মাথায় রেখেই পরামর্শটা দিয়েছেন৷ এবং ভারতীয় যাদুঘর যে সেই আন্তর্জাতিক মানচিত্রে স্রেফ এক প্রত্নদ্রব্যের গুদামঘর হয়েই থেকে গিয়েছে, নিজেকে বিকশিত করতে পারেনি, জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে পারেনি বা জ্ঞানার্জনে কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পারেনি, সেকথা স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন ডঃ মনমোহন সিং৷ মনে করিয়ে দিয়েছেন, মিউজিয়াম শব্দটার মধ্যেই কিন্তু মিউজ শব্দটা আছে৷ এটা অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করারই দ্যোতনা৷ ভারতীয় যাদুঘরকে ঠিক সেই ভূমিকাই নিতে হবে৷
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেশ আদৌ কতটা নেওয়ার মতো জায়গায় রয়েছে ভারতীয় যাদুঘর, সংশয় রয়েছে সেই নিয়েই৷ কারণ, ঐতিহাসিক ভাস্কর্যের মাথা ভেঙে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রাচীন প্রত্নবস্তু অসাবধানে সরাতে গিয়ে ভেঙে ফেলার মতো একাধিক লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে কলকাতার এই ভারতীয় যাদুঘরে৷ আর সাধারণ নাগরিককে ইতিহাস বা পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে যাদুঘরের যে ভূমিকা, তাও আদৌ আশাজনক নয়৷ যেমন, যাদুঘরেরই একটি দপ্তর আছে, যাদের কাজ বিখ্যাত এবং লোকপ্রিয় কিছু প্রত্নসামগ্রীর প্লাস্টার কাস্ট বানিয়ে বিক্রি করা৷ কিন্তু পাছে বেশি কাজের চাপ হয় যায়, সম্ভবত সেই কারণেই এই সুবিধের কথা অধিকাংশ দর্শনার্থী জানেন না৷ যাঁরা জানেন এবং নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন, তাঁরা প্রায় কখনই পছন্দের জিনিসটি পান না৷ নাম এবং পছন্দের প্রত্ন-নিদর্শনের নাম লিখিয়ে আসার একটা ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু তাতেও কখন যে ডাক আসবে, কেউই নাকি বলতে পারেন না!