দেবদাসী প্রথা
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ' করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে – এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ঐ অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন৷ এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে৷ আশা ছিল, এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িষায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী৷ কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী৷
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ এর পেছনে আছে চরম দারিদ্র্য, জাতিভেদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ এরপর অন্য কোনো পুরুষ ঐ মেয়েটির স্বামী হতে পারে না৷ খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাঁদের সারা জীবন কাটে কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ কিংবা সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়৷ মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্ত প্রভুদের যোগসাজশে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের ওপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে দেয়া হয় ধর্মীয় শিলমোহর৷ উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের৷
এই সামজিক তথা ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত৷ এর ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক উৎকীর্ণ আছে বিভিন্ন মন্দির গাত্রে৷ গুজরাটে প্রায় চার হাজার মন্দিরে ছিল প্রায় ২০ হাজার দেবদাসী যাঁদের নাচনিও বলা হতো৷ মন্দিরে পূজার কাজ ছাড়াও এদের নাচ গান করতে হত৷ ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ এন ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরিব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলির বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে – তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ কারণ প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র যেমন জাতক, কৌটিল্য কিংবা বাৎসায়নের কামশাস্ত্রে দেবদাসীর উল্লেখ পাওয়া যায় না৷
ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি৷ এই লজ্জাজনক অমানবিক কুপ্রথা নির্মূল করতে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়৷ কিন্তু উপযুক্ত সচেতনতা বা মোটিভেশন না থাকায় তা সফল হচ্ছেনা৷ এইচআইভি এবং যৌনবাহিত সংক্রমণ সম্পর্কে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, কী ধরনের চিকিৎসা করাতে হবে সে বিষয়ে সচেতনতা জাগানোর পাশাপাশি দেবদাসীদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করতে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছে কিছু স্বয়ংসেবী সংগঠন৷