ভারতে সংবাদসংস্থার ওপর সরাসরি আঘাত
২৯ জুন ২০২০পুরো নাম প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া, সংক্ষেপে পিটিআই। ভারতে ইংরাজি ভাষায় সব চেয়ে জনপ্রিয় ও বড় সংবাদসংস্থা। দুই পক্ষের বক্তব্য দিয়ে ঠিক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাঁদের সুনাম রয়েছে। কিন্তু ভারত-চীন সাম্প্রতিক বিরোধের মধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে, তারা জাতীয়তাবিরোধী খবর পরিবেশন করেছে। তারা জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক সংহতির বিরুদ্ধে কাজ করেছে।
অভিযোগকারী সরকারি সংবাদমাধ্যম প্রসার ভারতী। যার অধীনে রয়েছে দূরদর্শন এবং আকাশবাণী, মানে সরকারি টিভি ও রেডিও। এই অভিযোগ করার পর পিটিআই-এর সঙ্গে তাঁদের আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকিও দিয়েছে প্রসার ভারতী।
কেন এই অভিযোগ? প্রসার ভারতী বলেছে, সম্প্রতি পিটিআই যে খবর করেছে তা জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। দেশের ভিতরে তো বটেই বিদেশেও সেই খবর বহু সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করেছে। সূত্র জানাচ্ছে, পিটিআই এর একটা খবর ও একটা টুইট নিয়ে প্রসার ভারতী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। খবরটি হলো, দিল্লিতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদন। যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, ভারতই লাদাখে চীনের এলাকায় ঢুকেছিল। সংঘর্ষে চীনের কোনও দায় নেই। যাবতীয় দায় তিনি ভারতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় হলো একটি টুইট। চীনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য নিয়ে একটি টুইট। সেখানে বলা হয়েছিল, চীনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বার বার ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া এবং কাঠামো তৈরি করার অভ্যাস চীনকে ছাড়তে হবে। এই টুইট নিয়ে অভিযোগ হলো, প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন, ভারতীয় ভূখণ্ডে কেউ নেই, কোনও পোস্টও অন্য দেশের অধিকারে নেই, সেখানে কেন এই ধরনের টুইট করা হলো?
প্রসার ভারতী প্রতি বছর পিটিআই-কে প্রায় সাত কোটি টাকা দেয়। সেই চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছে তারা। পিটিআই-এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, তারা চিঠি খতিয়ে দেখে জানাবে। সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার জানাচ্ছে, পিটিআই দ্য প্রিন্টকে বলেছে, প্রসার ভারতীর প্রতিক্রিয়া 'অন্যায্য ও অপ্রয়োজনীয়'।
এরপরই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কারণ, এটা শুধু পিটিআই-এর প্রশ্ন নয়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত। প্রশ্ন হলো, এইভাবে দেশের সব চেয়ে পুরনো সংবাদসংস্থাকে কি জাতীয়তাবিরোধী আখ্যা দেওয়া যায়? তাদের ওপর চাপ দিয়ে সরকার কি নিজেদের পছন্দমতো খবর করতে বাধ্য করতে পারে? পিটিআই-এর অবসরপ্রাপ্ত ব্যুরো প্রধান অমিতাভ রায়চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''পিটিআই তো বহুদিন ধরে সংবাদিকতার চালু পদ্ধতিই অনুসরণ করেছে। দুই পক্ষের কথা তুলে ধরে খবর করেছে। যে প্রতিবেদনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ছিল চীনের রষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন। ভারতের অবস্থান নিয়ে পিটিআই প্রচুর খবর করেছে। নিরপেক্ষ সংবাদিকতা হলো গণতন্ত্রের কষ্টিপাথর। তাই সেটা অবশ্যই বজায় রাখা উচিত।''
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ''এটা স্বাভাবিক সময় নয়। লাদাখে চীনের সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি রীতিমতো উত্তেজক। সেই সময় দেশের সব চেয়ে বড় সংবাদসংস্থার একটা দায়িত্ব রয়েছে। তারা সেই দায়িত্ব থেকে বিচ্যূত হয়েছে। তাদের খবরে বিভ্রান্তি দেখা দিতেই পারে।'' বিশেষজ্ঞদের মতে, পিটিআই-এর কাছে যে হুমকি চিঠি পাঠিয়েছে প্রসার ভারতী, তার পিছনে সরকারের মদত রয়েছে। তারা খাতায় কলমে স্বশাসিত সংস্থা হলেও মূলত সরকার নির্দেশিত পথেই চলে।
প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''লাদাখে ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। যে প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে, সেখানে চীনের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। আমরা যদি ওই প্রতিবেদনের ইন্ট্রো পড়ি, তা হলে দেখা যাবে, চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেই তারা কপি শুরু করেছে। তারপর তারা চীনের রাষ্ট্রদূতের কোট দিয়েছে। সেখানে দেশদ্রোহের বিষয়টা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। এর পরের ফলো আপ কপি অবশ্যই ভারতের কথা নিয়ে যাবে।''
আরেক প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''চীনের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকারের পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের পাবলিসিটি উইং আছে, তারা উপযুক্ত ও কড়া জবাব দিতে পারত। এর জন্য কেন পিটিআই-কে হুমকি দেওয়া হবে? বড় অঙ্কের টাকা বন্ধ করার কথা বলা হবে?''
পিটিআই-এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। একসময় কে সি রায় তৈরি করেছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়া বা এপিআই। ১৯১৯ সালে তা রয়টার্স অধিগ্রহণ করে। তবে এপিআই নাম রেখে দেয়। ১৯৪৭ সালের ২৭ অগাস্ট পিটিআই তৈরি হয়। দুই বছর পরে তারা এপিআই-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে রয়টার্সের সঙ্গে তখনও যোগ ছিল। সেটা ছিন্ন হয় ১৯৫৩ সালে। জরুরি অবস্থার সময় ১৯৭৬ সালে পিটিআই, ইউএনআই, হিন্দুস্তান সমাচার, সমাচার ভারতী মিলে তৈরি হয় সমাচার। জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৮ সালে আবার সংবাদসংস্থা আলাদা হয়ে যায়। সারা দেশ জুড়ে পিটিআই-এর এক হাজারের বেশি কর্মী আছেন। আর পিটিআই চালায় একটি ট্রাস্ট, যেখানে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা আছেন। বোর্ডে তাঁদের প্রতিনিধিরা থাকেন। তিনজন মনোনীত প্রতিনিধি থাকেন। তাঁরা সাধারণত প্রথিতযশা ব্যক্তি হন।
ভারতে অন্যতম প্রধান এই সংবাদসংস্থার ওপর এই ধরনের চাপ দেওয়া নিয়ে তাই প্রবল আলোড়ন দেখা দিয়েছে।
জিএইচ/এসজি( পিটিআই, দ্য ওয়্যার, ডেকান ক্রনিকল)