ভারতে সাম্প্রদায়িকতা যায়নি
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭বাবরি মসজিদ ভাঙার বছরে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঐতিহ্য নিয়ে এক আলোচনাসভায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিলেন কলকাতার এক বুদ্ধিজীবী৷ তিনি বলেন যে, হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মুসলিম-বিদ্বেষ বরাবরই ছিল, আছে এবং থাকবে৷ প্রথমত, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এবং বহু হিন্দু পরিবারের উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসার যে যন্ত্রণা, তা এত সহজে যাওয়ার নয়৷ তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত এই যন্ত্রণার তীব্রতা একটু একটু করে কমবে৷ যে প্রজন্ম স্বচক্ষে দেশভাগ এবং শরণার্থী সংকট দেখেছে, তাদের যে রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই একই অনুভূতি হয়ত ততটা সক্রিয় থাকবে না৷ এক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা নেবে৷
কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, তেমনটা হয়নি৷ উলটে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল যখন পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ঘাঁটি গড়তে মরীয়া, তখন সামান্য খোঁচাতেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে মুসলিম-বিদ্বেষ৷ এবং না, শিক্ষা এক্ষেত্রে কোনো হেরফের ঘটায়নি৷ অতি উচ্চ শিক্ষিত, সফল পেশাদাররাও এখন প্রকাশ্যে বলছেন, ‘‘ওদের বড্ড বাড় বেড়েছে৷ শিক্ষা না দিলে চলছে না!'' কী রকম শিক্ষা? গুজরাটে যেমন দেওয়া হয়েছিল!
কখনো কখনো শিক্ষিত মানুষেরাও বলছেন এমন কথা! বিজেপি এমন আক্রমণাত্মক মানসিকতার প্রসারই চাইছে৷ যে কারণে এই বঙ্গভূমে রামায়ণ নিয়মিত পাঠে থাকলেও, পাঠান্তরে শ্রীরামচন্দ্র পুজো পাননি কখনও, অথচ আজ রামনবমী পালিত হচ্ছে৷ সে-ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মিছিল করে৷ দুর্গা পুজোর শেষে বিজয়া দশমী বাংলায় চিরকালই আত্মীয়-বন্ধুর পুনর্মিলনের উৎসব৷ সেদিন মুসলিম প্রতিবেশীর ঘরেও বিজয়ার নিমকি, নারকেল নাড়ু যায়, ঠিক যেভাবে ওদের ঘর থেকে আসে ঈদের সেমাই৷ কিন্তু এ বছর নাকি বিজয়া দশমী ‘শস্ত্র দিবস' হিসেবে পালিত হবে বাংলার কিছু জায়গায়৷ যুদ্ধজয়ের উৎসব হিসেবে৷
সমস্যা হচ্ছে, বিজেপির এই হিন্দুত্ববাদী কৌশলের পালটা হিসেবে আরও বিভ্রান্ত এক রাজনীতির চর্চা হচ্ছে৷ রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল এবং এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র বড় এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস ধর্মীয় সংস্কৃতি দিয়েই বিজেপির পুজোপাঠের সংস্কৃতির বিরোধিতা করতে চাইছে, যা কার্যত অসম্ভব এবং ভুল৷ কারণ, ভারতীয় ধর্ম নিরপেক্ষতার যে আদর্শের অন্তত বাঙালি মানসিকতায় এক ধরনের আত্মীকরণ হয়েছিল, তার থেকে বাঙালিকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই রাজনৈতিক কৌশল৷ সেখানেও ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে হিতে বিপরীত হচ্ছে৷ এই বছরেই যেমন, বিজয়া দশমীর পরের দিন মুসলমানদের মহরম পালিত হবে বলে সেই দিন দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ এই সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে, যার পুরো সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি৷
অথচ মুখ্যমন্ত্রী একবারও ভাবেননি, মহরমের মিছিল হয় দুপুরে, চলে বড় জোর বিকেল পর্যন্ত, আর প্রতিমা বিসর্জন শুরুই হয় সন্ধের পর থেকে৷ এর আগেও বহুবার বিজয়া দশমী এবং মহরমের তারিখ গায়ে গায়ে পড়েছে, কিন্তু কোনো অসুবিধে হয়নি৷ এবারেও মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর রাজ্যের একাধিক মুসলিম গোষ্ঠী জানিয়েছে, তারা এমন কোনো আবেদন সরকারের কাছে করেনি৷ সোজা কথায়, এটা সরকারের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, যার সঙ্গে বাঙালি মুসলিমদের কোনো যোগ নেই৷
পরিস্থিতিটাকে বাঙালি মুসলমিরা কীভাবে দেখছেন? বিশেষত শিক্ষিত, উদারপন্থি মুসলিমরা? অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক শামিম আহমেদের গলায় হতাশার সুর স্পষ্ট৷ তিনি পরিষ্কারই বলছেন, শিক্ষিত মুসলিমদের এখনও দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়৷ আর যাঁরা আছেন, তাঁরাও খুব বিভ্রান্ত এবং অসহায়৷ এই পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে, তাঁরা বুঝতে পারছেন না৷ বরং অনেক সময়ই ভুল প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেলছেন কোনো ঘটনায়, যার জন্য আফসোস হচ্ছে৷
আরেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী আবদুর রউফ আরও একটু স্পষ্ট করেছেন সংকটটা৷ তিনি বলছেন, যারা এইধর্মনিরপেক্ষতার স্খলন আটকাতে পারত, সাম্প্রদায়িকতার বিপদের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালিয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারত, সেই বামপন্থিরা আজ শক্তিহীন৷ জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী কংগ্রেসও অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে৷ তাছাড়া তৃণমূল কংগ্রেস ধর্মীয় সংস্কৃতি দিয়েই বিজেপির ধর্মীয় আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে চাইছে, যা শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনকও বটে৷ আবদুর রউফের সাফ কথা, বাঙালি মুসলমানদের ভুল বোঝানো হচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা এখন মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, যা সরকার গড়ার পক্ষে জরুরি বলে মমতা ব্যানার্জির হয়ত মনে হচ্ছে৷ কিন্তু শতকরার হিসেবে যে ভোটের অঙ্ক আর কষা হয় না, সেটা উত্তর প্রদেশে বিজেপি কিন্তু গত বিধানসভা ভোটে প্রমাণ করে দিয়েছে৷ ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ঐ রাজ্যেরও জনসংখ্যার ২০ শতাংশ কিন্তু মুসলিম৷ তা সত্ত্বেও সরকার গড়ার ক্ষেত্রে তাদের ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয়নি৷ প্রখর হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথ সেখানে দাপটে সরকার গড়েছেন এবং একের পর এক মুসলিম-বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন৷ কাজেই ভোটের হিসেবে আজ যে গুরুত্ব পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে পাচ্ছে, ভবিষ্যতে সেটা স্রেফ অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে৷ এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসও গুরুত্ব হারাতে পারে৷ কারণটা আবদুর রউফ তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বলেছেন যে, হিন্দুদের মুসলিম-বিদ্বেষ বরাবরই ছিল, এখনও আছে৷ বিজেপি তার সুযোগ নিচ্ছে মাত্র৷
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷