ভ্যাকসিন কূটনীতি, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ
৮ জানুয়ারি ২০২১ইউরোপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেন্ডের বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন পাওয়া না গেলে আগামী এক বছরে বিশ্ব অর্থনীতির জিডিপিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব হবে তিন দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলার৷ আর ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে পরিমাণ দাঁড়াবে এক দশমিক দুই ট্রিলিয়ন৷ কিন্তু এক দিকে বছরের শেষে এসে কোভিড-১৯ এর নতুন ধরন এবং অন্যদিকে সব মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে সারাবিশ্বে চলছে ভ্যাকসিন কূটনীতি৷ ঐতিহাসিকভাবে ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি' একটি প্রমাণিত শক্তি হলেও ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ'-এর কাছে তা অনেকবারই পরাস্ত হয়েছে৷ পরিণামে বেড়েছে উত্তর-দক্ষিণে অবিশ্বাস৷
গত কিছুদিন ধরে যারা কোভিড সংক্রান্ত খবরের দিকে নজর রাখেন, তাদের কাছে দু'টি শব্দ বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে৷ একটি ভ্যাকসিন কূটনীতি, আরেকটি ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ৷ ভ্যাকসিন কূটনীতির ইতিহাস অনেক পুরোনো৷ আভিধানিক অর্থে এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবহার হলো ভ্যাকসিন কূটনীতি৷ উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রতি চীন ও ভারতের বিশেষ আগ্রহের কথা তুলে ধরতে পারি৷ ব্যাপক অর্থে ভ্যাকসিন কূটনীতি বলতে শুধু অর্থায়নকে বুঝায় না, বরং ভ্যাকসিনের আবিষ্কার, কেনা-বেচা, সরবরাহের জন্য কৌশলগত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময় এই কূটনীতির অন্তর্ভুক্ত৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য কূটনীতির একটি শাখা হলো ভ্যাকসিন কূটনীতি, যার কারণে 'দা-কুমড়ো সম্পর্কের' রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র এক ঘাটে জল খেয়েছিল৷
ভ্যাকসিন কূটনীতি বিষয়ে একজন প্রসিদ্ধ গবেষক পিটার জে হটেজ৷ ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ জার্নালে ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ১৮০০ থেকে ১৮০৫ সালে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন, মেক্সিকো, ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভ্যাকসিন কূটনীতির প্রথম সফল প্রয়োগ হয়৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যকার দফায় দফায় যুদ্ধ ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দিয়েছিল বৃটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেন্নারের পোলিও'র ভ্যাকসিন আবিষ্কার৷ ঘোর শত্রু দেশের জাতীয় ইনস্টিটিউটকে পাঠানো চিঠিতে এডওয়ার্ড বলেছিলেন, ‘‘বিজ্ঞান কখনো যুদ্ধের জন্য নয়৷’’ সবশেষ ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কিছু রোগের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল৷ আর সম্প্রতি কভিডের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতে ভ্যাকসিন কূটনীতির ব্যাপকতা বেড়েছে৷ হটেজ মনে করেন, ‘‘ভ্যাকসিন হলো বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর হাতিয়ার৷’’ উদাহরণ হিসেবে চীনের সাম্প্রতিক 'হেলথ সিল্ক রোড' নীতির কথা বলা যায়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন কোভিড ভ্যাকসিনকে একদিকে তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধার, অন্যদিকে প্রভাবের বলয় বিস্তারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে৷ ধনীদের ভ্যাকসিন অলীক স্বপ্ন মনে করে অনেক দেশই এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে৷
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের সবশেষ (৫ জানুয়ারি ২০২১) তথ্যানুযায়ী, ৭টি ভ্যাকসিন এ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ এর মধ্যে বায়োএনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিনটি সর্বাধিক ৪৮টি দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ এ ছাড়া মডার্না ২টি, স্পুটনিক-ভি ৪টি, অক্সফোর্ড/এসট্রাজেনকা ৫টি, চীনের সাইনোফার্ম ৫টি, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড এবং বায়োটেকের কোভাক্সিন ১টি দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ এর মধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল সর্বাধিক ১২টি দেশে হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত ৭৩টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে, যা আমাদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছে৷ এর মধ্যে ১৮টি ভ্যাকসিন ৩য় পর্যায়, ৩২টি ভ্যাকসিন ২য় পর্যায় এবং আরো ২৩টি ভ্যাকসিন ১ম পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে৷ বিশ্বের মাত্র ৪৩টি দেশে কোভিড ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে৷
পর্দার অন্তরালের খেলাও চলছে৷ খেলাটি হলো কার আগে কে পাবে বা কিনবে এই ভ্যাকসিন৷ ফলে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ নামে এক নেতিবাচক শব্দবন্ধের সাথেও আমাদের পরিচয় ঘটেছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের প্রকোপ পুরোদমে বেড়েই চলেছে৷ এই জাতীয়তাবাদ বিশ্ব স্বাস্থ্যকে শুধু একটি ব্যবসা হিসেবেই দেখে৷ যখন কোনো দেশের সরকার অন্য দেশকে সুযোগ না দিয়ে নিজ দেশের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে ফেলে, তখন এই প্রকোপ শুরু হয়৷ এর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, বিশ্বের ধনী দেশগুলো নিজ দেশের মানুষের জীবন নিয়েই শুধু চিন্তা করে, অন্য দেশকে সাহায্য করা কিংবা অতিমারির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই করার কোনো মনোভাব তাদের মধ্যে থাকে না৷ ফলে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে ধনী ও গরিব দেশগুলো মধ্যে নতুন ধরনের বৈষম্য৷ এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘মাই নেশন্স ফার্ষ্ট' ধারনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগেই ধনী দেশগুলো প্রি অর্ডারের মাধ্যমে কোটি কোটি ডোজের প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে৷ অক্সফামের তথ্যানুযায়ী, আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, ম্যাকাও, জাপান, সুইজারল্যান্ড করোনা ভ্যাকসিনের অর্ধেকেরও বেশি ডোজ কেনার আগাম চুক্তি সেরে ফেলেছে৷ অথচ জনসংখ্যার বিচারে এই দেশগুলোতে পৃথিবীর মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষের বসবাস৷ গ্লোবাল নিউজের মতে, যুক্তরাজ্য একাই অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ৩০ মিলিয়ন ডোজ কেনার চুক্তি করেছে৷ ইউরোপের আরো চারটি দেশ ৪০০ মিলিয়ন ডোজ কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র অক্সফোর্ডের ৩০০ মিলিয়ন ও ফাইজারের ১০০ মিলিয়ন ডোজ কেনার চুক্তি করেছে৷ পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জোট বলছে, ধনী দেশগুলো তাদের মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশ ভ্যাকসিন কিনে রেখেছে৷ অক্সফাম বলছে, ধনী দেশগুলোর এ আচরণের কারণে ২০২১ সালের মধ্যে ৬৭টি নিম্ন আয়ের দেশের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন পাবে না৷
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ নতুন নয়, এর ইতিহাস আছে৷ ধনীরা আগাম চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাকসিন কিনে নেয়ায় ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হওয়া সত্ত্বেও এইচ৫এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন কিনতে পারেনি৷ ২০০৯ সালে ধনী দেশগুলো এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা (সোয়ান ফ্লু নামে পরিচিত) ভ্যাকসিনের প্রায় সব ডোজ কিনে নেয়ায় বেশি আক্রান্ত দেশগুলো ভ্যাকসিন পায়নি৷
ধনী দেশগুলোর এই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও আশার আলো ছড়াচ্ছে কোভ্যাক্স গ্লোবাল ভ্যাকসিন ফ্যাসিলিটি৷ এর আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে ভ্যাকসিনের ২ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করা হবে৷ এর মধ্যে ৯২টি দেশ রয়েছে যারা বিনা পয়সায় পাবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি৷ ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহুত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে ইতিমধ্যে কোভ্যাক্সকে ৮৭০ মিলিয়ন ইউরো দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
কোভ্যাক্সের আওতায় থাকায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে আছে৷ কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি যতই ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর খুব সহসা ভ্যাকসিন পাওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ হয়ে আসছে৷ প্রথমদিকে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে 'সবার জন্য দুয়ার খোলা’ নীতি গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ৷ চীনকে যেমন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে আবার তার বিরোধী পক্ষ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটি অব ইন্ডিয়ার সাথে চুক্তি করে রেখেছে৷ চুক্তি অনুযায়ী, সেরাম ইনস্টিটিউট ছয় মাসের মধ্যে তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে সরবরাহ করবে৷ তবে সম্প্রতি ভারতের নিষেধাজ্ঞার আকস্মিক খবর মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যদিও দু'দেশের সরকার বলছে বাংলাদেশ ভারত থেকে ভ্যাকসিন পাবে৷ ভ্যাকসিনের জাতীয়তাবাদের কষ্মিনকালে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি বুদ্ধিদীপ্ত ফল বয়ে আনতে পারে না৷ এতে দেশটি কূটনৈতিক ফায়দা নেয়ার সুযোগ খুঁজতেই পারে৷ তখন বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন আমদানির জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে৷ অতীতে কূটনৈতিক ব্যর্থতার জন্য উত্তর-দক্ষিণের ব্যবধান এবং দুয়ের মধ্যকার অবিশ্বাস বহুবার বেড়েছে৷ তাই বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন কূটনীতি আরো জোরদার করতে হবে৷ সম্ভাব্য সব উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ ও ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে৷ পাশাপাশি ভ্যাকসিনের বিতরণ ব্যবস্থাপনার কথাও ভুলে গেলে চলবে না৷ বিশেষ করে 'কোল্ড চেইন কাঠামো ও ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট নিয়ে ভাবাও জরুরি৷ সামগ্রিক বিষয়ে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে জনমনে বিভ্রান্তি, বিতর্ক, সংশয়ের সৃষ্টি হবে না৷ ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়’ নীতি সরকারের জন্য খারাপ বৈকি ভালো ফল বয়ে যে আনে না সেটি এই কোভিড ইস্যুতেই অনেকবার দেখা গেছে৷