মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ আবিষ্কারে পট্সডাম
৩০ জানুয়ারি ২০১৮তাছাড়া এ ঘটনার ১০০ বছর পর মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ আবিষ্কারেও যে পট্সডামের ভূমিকা আছে৷
শহরের কোলে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউটে অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হিসেবে কাজ করেন ভিভিয়্যাঁ রেমঁ৷
এখানকার বিজ্ঞানীরা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করার বিভিন্ন উন্নততর মডেল সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন৷ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন প্রথম মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ নিরূপণ করা সম্ভব হয়, রেমঁ তখন তাঁর অফিসে ছিলেন৷ দিনটা তিনি কোনোদিন ভুলবেন না, বলেন রেমঁ৷ তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমবারের মতো একটা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ পাওয়া একটা চমক ছিল, একটা ‘শক' ছিল....অনেক জোরালো! ডিটেক্টরটা চালু করতেই, খানিকটা ভাগ্যক্রমে আমরা সেটা পেয়ে যাই৷ ওটা যে সত্যিই বাস্তব, তা নিশ্চিত করতে আমাদের বেশ কিছুটা সময় লেগেছে৷''
বিজ্ঞান যাঁদের বিষয় নয়, তাঁদের কাছে যা শুধুমাত্র কিছু আঁকাবাঁকা রেখা বলে মনে হবে, বিজ্ঞানীদের কাছে তা এক নাটকীয় কাহিনি৷ দু'টি ব্ল্যাক হোল উচ্চগতিতে ঘুরপাক খেতে খেতে পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে৷
গবেষকরা প্রথম যে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গগুলি সরাসরি শনাক্ত করতে পারেন, সেগুলি জ্যোতির্মণ্ডলের এই ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল৷
পরের প্রগতি আসে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে, যখন গবেষকরা প্রথমবারের মতো দু'টি ঘন নিউট্রন তারকার মরণপ্যাঁচ ‘দেখতে' পান৷ মহাশূন্যে ঠিক কোথায় এই নাটকীয় সংঘাত ঘটেছে, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ডিটেক্টর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তা-ও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়৷
এর ফলে সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ টেলিস্কোপ তারায় তারায় ধাক্কা লাগার ঐ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে পারে৷ ভিভিয়্যাঁ রেমঁ জানান, ‘‘মাল্টিমেসেঞ্জার অ্যাস্ট্রোনমির যুগ শুরু হয় ঐ আগস্ট মাসে৷ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে মহাকাশ ও ব্রহ্মাণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করার কাজ শুরু হয়৷''
আইনস্টাইন স্বয়ং নিশ্চয় খুব খুশি হতেন৷ ১০০ বছর আগে তিনি মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কিন্তু সেই তরঙ্গের হদিশ পাওয়া কখনো সম্ভব হবে কিনা, সে ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ ছিল৷ মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ সৃষ্টি করার মতো ভারী কোনো বস্তু আইনস্টাইনের আমলে পদার্থবিদদের জানা ছিল না – রেমঁ ব্যাখ্যা করলেন৷
২০১৫ সালে যে সব পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়, পট্সডামের এই অবজারভেটরি ছিল তাদের মধ্যে একটি৷ ঐ আবিষ্কারের জন্য দু'বছর পরে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়৷
তিনজন পথিকৃৎ গবেষক রে ওয়াইস, কিপ থর্ন ও ব্যারি ব্যারিশ যে কাজটির জন্য পুরস্কৃত হন, তা বস্তুত বহু দশকের গবেষণার ফল৷ রেমেঁর কথায়, ‘‘এত বছরের কঠিন পরিশ্রম, দীর্ঘদিন পরে এই আশ্চর্য স্বীকৃতি, এই সম্মান পাওয়াটা সত্যিই অকল্পনীয়!''
সারা বিশ্বের এক হাজারের বেশি বিশেষজ্ঞ এই বুনিয়াদি আবিষ্কারে তাঁদের অবদান রেখেছেন৷ পট্সডাম ইনস্টিটিউট যে সব কমপিউটার সিমিউলেশান সরবরাহ করেছে, তা থেকে পদার্থবিদরা জানতে পেরেছেন, তাদের হিসেবনিকেশে তারা ঠিক কোন ধরনের সংকেতের খোঁজ করবেন৷
ভিভিয়্যাঁ বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে আমার সত্যিই ভালো লাগে৷ বলতে কি, কাজটা আগেও খুব আকর্ষণীয় ছিল৷ কিন্তু এখন এই সব আবিষ্কারের পর, কাজটা দারুণ! মনে হয়, আমরা যেন রোজ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বেড়াই, এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, আগে যে সব প্রশ্ন করার কথা আমরা ভাবতেই পারতাম না৷''
পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে তথাকথিত ‘ডার্ক ম্যাটার'-এর রহস্য ভেদ করা৷ ‘ডার্ক ম্যাটার' নক্ষত্রপুঞ্জগুলিকে ধরে রাখে বলে মনে করা হয়৷ এযাবৎ অদৃশ্য এই পদার্থটির উৎপত্তি ব্ল্যাক হোল থেকে হতে পারে৷ অপরদিকে তাঁদের মাধ্যকর্ষণ তরঙ্গের ফলে আজ ব্ল্যাক হোলগুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব৷
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের সংকেতগুলিকে ধ্বনিতে পরিণত করা হয়৷ গবেষকরা আগামীতে নক্ষত্রপুঞ্জের এই সব ‘শ্রুতি' আরো বেশি শোনার আশায় রয়েছেন, যখন ডিটেক্টরগুলিতে নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে নতুন আবিষ্কারের পথে পা রাখা যাবে৷
কর্নেলিয়া বর্মান/এসি