মার্কিন মুসলিম সমাজে বর্ণবৈষম্য
১ জুলাই ২০২০ইসলামিক স্কুলে পড়ার সময় নিজের শিক্ষাজীবনের কিছু কথা এখনো মনে পড়ে হিন্দ মাক্কির৷ মধ্যপ্রাচ্য থেকে অভিবাসী হয়ে আসা মুসলিম পরিবারের অনেকেই কথার মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ অ্যামেরিকানদের ‘আবদ' বা ‘দাস' বলে উল্লেখ করতো৷ কিন্তু এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালে কী হতো? মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ নিয়ে এক আলোচনায় শিক্ষার্থী হিন্দ মাক্কি নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এভাবে, ‘‘অন্তত ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে যারা এসব শব্দ ব্যবহার করছে, তারা উত্তর দিতো ‘ও, আমরা তো তোমাকে বলছি না, অ্যামেরিকানদের বলছি৷'''
হিন্দ মাক্কি নিজেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ আরব মুসলিম নারী বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন৷ সেমিনারে মাক্কি বলেন, ‘‘কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী যে মানসিকতা গড়ে উঠেছে নানা স্তরে, এটিও তার একটি রূপ৷''
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে পুরো দেশ স্থবির করে দেয়া বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন মুসলিমরাও৷ এর পর থেকে মার্কিন মুসলিম সমাজে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মানুষকে কিভাবে দেখা হয়, তা নিয়েও আলোচনা চলছে৷ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলিমদের বাস অ্যামেরিকায়৷ প্রশ্ন উঠছে, ইসলাম যখন সবাইকে সমানভাবে দেখার আহ্বান জানাচ্ছে, সেই ধর্মের অনুসারীরা কি বর্ণবাদী আচরণ থেকে বের হতে পারছেন?
মাক্কি বলেন, ‘‘এখন সবাই এ নিয়ে আলোচনা করছে৷ ৭০-এর দশক থেকে অ্যামেরিকায় বাস করা কোনো বয়স্ক ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য, এমনকি হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরাও৷ যেসব বর্ণবাদী শব্দ কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়, সেসব নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হওয়া উচিত৷ জাতিগত বৈষম্য আমরা কিভাবে দূর করতে পারি, এ নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত৷''
মুসলিম সমাজে আলোচনা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম সমাজ বেশ বৈচিত্র্যময়৷ কোনো একক জাতিগত আধিক্য নেই এখানে৷ তবে ২০১৭ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গরা এর প্রায় ২০ শতাংশ৷
বর্ণবাদবিরোধী মুসলিমদের সংগঠন মুসলিম এআরসি -র নির্বাহী পরিচালক মার্গারি হিল জানিয়েছেন, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনার পর এখন আরো বেশি মুসলিম এ নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন৷ আরবি, বাংলা এবং অন্যসব ভাষাতেও কোন কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবে এবং কোনটা ‘উচিত না' সেসব তথ্য জানতে চাইছেন তারা৷ কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছেন কাউকে ‘ব্ল্যাক' বলা যাবে, নাকি ‘আফ্রিকার অ্যামেরিকান' বললে ভালো হবে৷
হিল বলেন, ‘‘আমরা মুসলিমদের আহ্বান জানাই অতীতের কোনো কুসংস্কার বা বিদ্বেষ মনের মধ্যে থেকে থাকলে তা ঝেড়ে ফেলুন৷ এখন সত্যিকার অকৃত্রিম সম্পর্ক গড়ে তোলার সময়৷''
মিশিগানের অ্যামেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস কাউন্সিলের পরিচালক দাউদ ওয়ালিদও এই আলোচনা শুরু হওয়ায় আশাবাদী৷ কিন্তু তার প্রশ্ন, ‘‘এই বিক্ষোভ শেষ হয়ে গেলেও কি মুসলিম সমাজে আলোচনাটা চলবে?''
বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ওয়ালিদ৷ সেসব সংগঠনেও বিভিন্ন বর্ণের মুসলিমকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি৷
ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ অ্যামেরিকা- ইসনা-র নির্বাহী পরিচালক বাশারাত সলীমও ওয়ালিদের এই আহ্বানের সঙ্গে একমত৷ সলীমের ইসনা সংগঠনের পরিচালনা বোর্ডে কোনো কৃ্ষ্ণাঙ্গ মুসলিম নেই৷ নিজের সংগঠনে জাতিগত বিভেদ কমিয়ে আনতে অনেক কিছু করার কথা বললেও এখনো অনেক কিছু করা বাকি বলেও স্বীকার করেন সলীম৷
উদাহরণস্বরূপ ইসনার এক বার্ষিক সম্মেলনের কথা বলেন তিনি৷ আফ্রিকান-অ্যামেরিকান মুসলিম নেতাদের কথা বলার আহ্বান জানানো হলেও তাদের পক্ষ থেকে কেউ আসেননি৷ সলীম বলেন, ‘‘আমাদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো বেশি আলোচনা প্রয়োজন৷''
অভিবাসী বনাম কৃষ্ণাঙ্গ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন৷ একদিকে বর্ণবাদ অন্যদিকে ইসলামবিদ্বেষের থাবায় তারা বিপর্যস্ত৷
বর্ণবাদের স্বীকার হওয়াটা কখনো কখনো খুব ‘ক্লান্তিকরও' হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন মার্গারি হিল৷ তিনি জানান, একবার একটি দোকানে কোরান কিনতে গেলে দোকানদার তাকে আরবিতে ‘দাস' বলে উল্লেখ করেন৷ দোকানের মালিক ছিলেন আরব মুসলিম৷ এক পর্যায়ে দোকানদার তাকে জিজ্ঞেন করেন তিনি সত্যিই কোরান পড়তে পারেন কিনা৷
ওয়ালিদ মনে করেন, ইসলাম সবসময়ই বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছে৷ ফলে ইসলাম যা বলেছে, মুসলিমরা সেটি সঠিকভাবে পালন করলেই এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব৷ কেবল আলোচনা এবং সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা ও মেলামেশার মাধ্যমে সম্প্রীতি গড়ে তুললেই সেটি সম্ভব বলে মনে করেন অ্যামেরিকার মুসলিম নেতারাও৷
এডিকে/এসিবি (এপি, আটলান্টিক, নিউ ইয়র্ক টাইমস)