মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের একটি হামলা কি ভারতকে ভাবাচ্ছে?
২২ নভেম্বর ২০২৩প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স' বা থ্রিবিএইচএ-র কার্যকলাপের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে ভারত কর্তৃপক্ষ৷
নতুন দিল্লির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে, বিশেষ করে মণিপুর ও মিজোরামে, যেখানে সীমান্ত পেরোলেই মিয়ানমার৷
এই থ্রিবিএইচএ'র সদস্য মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), দ্য টা'আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ও দ্য আরাকান আর্মি (এএ)৷ ২৭ অক্টোবর মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের শান রাজ্যে হামলা চালায় তারা৷
‘অপারেশন ১০২৭' নামের এই হামলায় তারা নিশানা করে ১৩৫টি সামরিক ঘাঁটিকে, জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন৷
সাম্প্রতিক সহিংসতা ঘরছাড়া করছে শরণার্থীদের
চীনের সাথে মিয়ানমারের সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী৷ এছাড়া হারিয়েছে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের কাছে অবস্থিত রিহখাওডর শহরের নিয়ন্ত্রণও৷
সহিংসতা গিয়ে পৌঁছেছে থাইল্যান্ডের নিকটবর্তী মিয়ানমারের কায়াহ রাজ্যে, ভারতের নিকটবর্তী সাগায়িং ও চিন প্রদেশেও৷
হানাহানির ফলে মিয়ানমারের হাজার হাজার মানুষ গত সপ্তাহে মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন৷ এর মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও৷ পরে তাদের আরেকটি সীমান্ত পারাপারের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় ও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়৷
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী সাংবাদিকদের জানান, ‘‘আমরা মিয়ানমারে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের কথা আবার মনে করাচ্ছি৷ চিন প্রদেশে রিহখাওডর এলাকায় সহিংসতার ফলে মিয়ানমারের মানুষ ভারতের দিকে চলে আসছেন৷ সীমান্তের এত কাছে এসব ঘটায় আমরা গভীরভাবে চিন্তিত৷''
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে মিজোরামের জন্য তা সমস্যাজনক হতে পারে, কারণ মিয়ানমারের সাথে ৫১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র নয়৷
লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক অভিনাশ পালিওয়ালের মতে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একটি দ্বিমুখী নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করেছে৷ মিয়ানমারে ভারতের বৃহত্তর স্বার্থ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সামরিক জান্তাকে সমর্থন করে যাচ্ছে৷ অন্যদিকে, সীমান্তে টহলও বাড়াচ্ছে৷
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ পালিওয়াল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মণিপুরের পরিস্থিতির সাথে মিয়ানমারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে৷ ফলে, নতুন দিল্লিতে আগামীতে নতুন সরকার এলেও যে তাদের নীতি বদলাবে, তা নয়৷ এই সহিংসতা যদি জান্তা সরকারকে সরাতে সক্ষম হয়, যা এই মুহূর্তে নিশ্চিত নয়, তাহলে ভারতকে বিদ্রোহী নেতৃত্বের সাথে বোঝাপড়ায় যেতে হবে৷''
১৫ অক্টোবর ভারতের ডেপুটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিক্রম মিস্ত্রি মিয়ানমারে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন৷ সেখানে জাতিগত সংঘাত নিরসনে শান্তিচুক্তির ওপর জোর দেন তিনি৷
ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক কি অবিচল থাকবে?
সমালোচকদের মতে, ২০১৫ সালের দেশব্যাপী যুদ্ধবিরতি চুক্তি (এনসিএ) ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে বিফল প্রমাণিত হয়েছে৷
কিন্তু নতুন দিল্লি তবুও মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে৷ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মোট ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র ও অন্যান্য কাঁচামাল ভারত সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ও প্রাইভেট কোম্পানিরা তুলে দিয়েছে জান্তার হাতে, জানাচ্ছে মে মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন৷
অরিন্দম বাগচী বলেন, ‘‘তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে, সহযোগিতা রয়েছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে৷ আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদের স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল৷''
একটি স্বাধীন গবেষণা ফোরাম মান্ত্রায়ার প্রতিষ্ঠাতা শানথি মারিয়েট ডিসুজার মতে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মিয়ানমার প্রসঙ্গে নীতি বদল করছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘যেভাবে ভারত জান্তার সাথে সম্পর্কিত, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করছে, তাতে বরং উল্টোটাই প্রমাণিত হচ্ছে৷ এবং সমান্তরালভাবে যে সরকার রয়েছে, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট, তারা নতুন দিল্লিকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও জান্তা-ঘেঁষা ভারতীয় নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি৷''
ডিসুজার মতে, এমন দ্বৈত নীতির মাধ্যমে নতুন দিল্লি আসলে ভাবছে যে বিদ্রোহী কার্যকলাপ আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ও জান্তা সরকারই ক্ষমতায় থাকবে৷
তার মতে, ‘‘নতুন দিল্লি অবশ্যই এই সহিংসতার প্রভাব নিয়ে চিন্তিত, বিশেষ করে উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যে৷ কিন্তু তারা সহিংসতা কমানোয় ভূমিকা রাখার বদলে আশা রাখছে জান্তা সরকারের ওপরেই৷''
মুরলী কৃষ্ণন (নতুন দিল্লি)/এসএস