চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি
২৮ এপ্রিল ২০১৩ফোর্থ এস্টেট৷ বলা হয় সংবাদমাধ্যমকে৷ গণতন্ত্রের যে চতুর্থ স্তম্ভটির উপর নির্ভর করে থাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং সর্বোপরি, সামাজিক দায়বদ্ধতা৷ প্রশাসন ত্রুটিপূর্ণ হলে ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের, বিভ্রান্তির সময়ে সঠিক দিকনির্দেশ করার দায়িত্ব, জনমত গড়ে তোলার দায়িত্বও সংবাদমাধ্যমের৷ নিরপেক্ষতা তার মূল ধর্ম হলেও সংবাদমাধ্যম বস্তুত পক্ষ নেয় মানুষের, সমাজের৷ সেখানে সংবাদমাধ্যম কখনও যদি সরকার বা রাষ্ট্রশক্তির পক্ষ নিয়ে কথা বলে, সেটাকে আদর্শচ্যুতি হিসেবেই দেখা হয়৷ তুলনায় রাজনীতিকদের বিচ্যুতি বা বিপথগামীতা অনেক বেশি সহনীয় কারণ, তার দৃষ্টান্ত আজকের দিনে অনেক বেশি৷ দুর্নীতি বা দুষ্কর্মের সঙ্গে রাজনীতিকদের বোঝাপড়াও বহু দিনের পুরনো৷ কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দুরভিসন্ধি এবং দুর্নীতির এমন ঘনিষ্ঠ সংযোগ এর আগে কখনও দেখা যায়নি, যা দেখা গেল সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে৷
সন্দেহের সূত্র সারদা সংস্থার মালিক এবং পশ্চিমবঙ্গের হালের চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির পান্ডা সুদীপ্ত সেনের সিবিআই-কে লেখা ১৮ পাতার একটি চিঠি৷ অবশ্য সেই চিঠির বয়ানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে এবং গোটা বিষয়টাই তদন্তসাপেক্ষ৷ কিন্তু ঘটনা হলো, ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠানো ওই লিখিত অভিযোগে সুদীপ্ত সেন একাধিক সাংবাদিক, এমনকি একজন সংবাদপত্র-সম্পাদকের বিরুদ্ধেও কার্যত ব্ল্যাকমেলিংয়ের অভিযোগ এনেছেন৷ সরাসরি তাদের নাম উল্লেখ করে জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে নানা অছিলায়, কখনও সম্পাদকীয় সাহায্য দেওয়ার বিনিময়ে, কখনও প্রশাসনিক নিরাপত্তা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে এই সাংবাদিকেরা নাকি নিয়মিত তাঁর থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রায় হাত মুচড়ে নিয়ে গিয়েছেন৷ এমনকি এক সাংসদ-সাংবাদিক নাকি রীতিমতো গুন্ডাবাহিনী নিয়ে তাঁর দপ্তরে এসে, জোর করে তাঁকে দিয়ে নামমাত্র মূল্যে একটি টিভি চ্যানেলের মালিকানা লিখিয়ে নিয়েছিলেন বলে সিবিআই-কে জানিয়েছেন সুদীপ্ত সেন৷
মজার কথা হচ্ছে, যা সিবিআই-কে লেখা সুদীপ্ত সেনের ওই চিঠির সূত্রেই জানা গিয়েছে যে, তাঁর চিট ফান্ড ব্যবসার বিরুদ্ধে একটি বাংলা দৈনিক এবং তার কার্যনির্বাহী সম্পাদক যেভাবে লিখতে শুরু করেছিল, তার মোকাবিলা করতেই তিনি তাঁর জমি-বাড়ির ব্যবসা এবং প্রকারান্তরে চিট ফান্ডের কারবারকে সুরক্ষিত রাখতে নিজেই মিডিয়া-ব্যবসায় নামার কথা ভেবেছিলেন৷ কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সুদীপ্ত সেন তাঁদেরই হাত ধরেছিলেন, যাঁরা তাঁর নিজের বয়ান অনুযায়ীই, তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছিল৷ একই সঙ্গে, একই দিনে একটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র চালু করেন সুদীপ্ত, সারদা সংস্থার মিডিয়া শাখা বেঙ্গল মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে৷ এর পর একে একে একটি হিন্দি, দুটি উর্দু, আরও একটি বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিক, সেই সঙ্গে মেয়েদের একটি পাক্ষিক পত্রিকার মালিক হয়ে বসেন তিনি৷ পাশাপাশি গোটা পাঁচেক বন্ধ হতে বসা বা অর্থাভাবে ধুঁকতে থাকা টিভি চ্যানেলও কিনে নেন সুদীপ্ত সেন৷ এছাড়া একটি বাংলা নিউজ চ্যানেল তিনি আগেই কিনেছিলেন৷ সব মিলিয়ে তিনিই হয়ে ওঠেন রাজ্যে বাংলা সংবাদমাধ্যমের স্বঘোষিত সম্রাট৷
সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত সেন জানিয়েছেন, মিডিয়ার ব্যবসা করতে গিয়েই তাঁর ভরাডুবি হয়েছে৷ প্রতি মাসে তাঁকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে যেতে হয়েছে সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মীদের৷ কিন্তু ধন্দ রয়েছে এখানে৷ সুদীপ্ত সেন তাঁর চিট ফান্ড ব্যবসার মাধ্যমে জোগাড় করা কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে দেখানোর জন্যই কি ইচ্ছাকৃতভাবে তার থেকে কিছু টাকা অকাতরে বিলি করেছিলেন? কারণ কাগজ বা টিভি চ্যানেল চালানোর যে আবশ্যিক পরিকাঠামো এবং বন্দোবস্ত, যাতায়াতের গাড়ি থেকে শুরু করে কাগজ ছাপানোর খরচ, প্রতিটা ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা বাকি রেখেছেন সুদীপ্ত সেন৷ সেটাও প্রায় শুরুর দিন থেকেই৷ কাজেই প্রশ্নটা আগাগোড়াই ছিল যে যিনি একটা চ্যানেল বা কাগজই যেখানে ঠিকভাবে চালাতে পারছেন না, তিনি একের পর এক নতুন কাগজ এবং চ্যানেল চালু করে যাচ্ছেন কোন ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে? শেষের দিকে তো কয়েক মাস তিনি সাংবাদিকদেরও বেতন না দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছেন৷
কিন্তু সিবিআই-এর কাছে করা লিখিত অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তা হলে এটাই ঘটেছিল যে এতগুলো খবরের কাগজ এবং টিভি চ্যানেলের প্রাপ্য খরচ না মেটালেও মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাংবাদিক-সম্পাদককে নিয়মিত মোটা টাকার মাসোহারা দিয়ে গিয়েছেন সারদা সংস্থার কর্ণধার৷ অন্যদিকে ওই সাংবাদিকেরাও নিজেদের অধস্তন সহকর্মী সাংবাদিকদের বঞ্চিত রেখে কেবল নিজেরাই পকেট ভর্তি করেছেন সুদীপ্ত সেনের টাকায়, যা আদতে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে ঠকিয়ে নেওয়া টাকা৷ সংবাদমাধ্যমকে সচল রাখার উদ্দেশ্য দু'পক্ষের কারোরই ছিল না৷ সোজা কথায়, পশ্চিমবঙ্গের এই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে পরোক্ষে জড়িত ছিলেন কয়েকজন সাংবাদিকও৷