মোদী সরকার ও আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে সংখ্যালঘুদের ভাবনা
২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ভারতের কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নাকভি সম্প্রতি বলেছেন, গত নির্বাচনে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ ভারতীয় জনতা পার্টি, অর্থাৎ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন৷ ২০১৯-এ মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে ভোট দেবেন৷ এ তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ আশা, নাকি অলীক কল্পনা তা নিশ্চিত করে বলতে হলে অন্তত আরো কয়েক মাস অপেক্ষা করতেই হবে৷
তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকজন মানুষের কাছে ডয়চে ভেলে জানতে চেয়েছিল,কেন্দ্রীয় সরকার ও আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন৷
১২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে প্রায় ২৫ কোটি সংখ্যালঘু৷ তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি এবং সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত বৌদ্ধ ধর্মগুরু অরুণজ্যোতি ভিক্ষু৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘সব দেশেই সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় থাকে৷ সব ধর্মেই শান্তি ও অহিংসার কথা বলা হয়েছে৷ সরকারের উচিত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া৷ ভারতে দলিত ও মুসলিমদের ওপর বারংবার আক্রমণ হয়েছে৷ সরকার তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ এছাড়াও নোটবন্দি, জিএসটি ইত্যাদি সরকারি সিদ্ধান্তে আর পাঁচজনের মতো সংখ্যালঘুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷'' তিনি আরো বলেছেন, ‘‘পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে সংখ্যালঘু মানুষের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে৷ বর্তমান সরকারের ওপর মানুষ যে ক্ষুব্ধ, তা অত্যন্ত স্পষ্ট৷''
দিল্লির কনটপ্লেস-সংলগ্ন গুরুদোয়ারার সামনে কথা হচ্ছিল ষাটের চৌকাঠ পার হওয়া মনপ্রীত সিংয়ের সঙ্গে৷ দেশ, রাজনীতি নিয়ে কথা উঠতেই বললেন, ‘‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ভারতের ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ ‘সংখ্যালঘু' শব্দটা থাকা উচিত নয়৷ সবার দেশ৷ সবাই সমান৷ কারো বাড়তি সুবিধা, কাউকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করার লক্ষ্যে ভোটবাক্স ভরে ওঠে৷ তাছাড়া সবটাই রাজনীতিকদের ফাঁকা আওয়াজ৷ আম জনতা বোকার মতো সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নিয়ে মাথা ঘামায়৷ নেতাদের কথায় মেতে উঠে হানাহানি করে৷ আবার ভোটও দেয়৷''
একই প্রশ্ন করা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাছে বিজয় এনক্লেভের বাসিন্দা জন এমুয়েলকে৷ এমুয়েলের স্পষ্ট জবাব, ‘‘এবার বিজেপি সরকারের পতন অনিবার্য৷'' তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ধর্ম ও রাজনীতিকে মিশিয়ে সরবত করে খাওয়ানো হচ্ছে সাধারণ মানুষকে৷ দেশ যে সবার সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সব সময়৷ গো-রক্ষকদের তাণ্ডব কারো অজানা নয়৷ বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে কত জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, সবাই জানেন৷ কিন্তু, কেউ জানেন না হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে কিনা৷ হয়নি৷ দলিত ও সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে দিনযাপন করছেন৷ তাঁরা নিজেরাই আতঙ্কের কারণকে দূর করবেন৷''
পশ্চিমবঙ্গের সমূদ্র উপকূলবর্তী জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুদ হোসেন জেলা পরিষদের প্রাক্তন সহকারী সভাধিপতি৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনীতি করেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘ভারত সহনশীল দেশ৷ সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা করে কিছুর প্রয়োজন নেই৷ তবে অন্যদের মতোই সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বন্দোবস্ত সবসময় কাম্য৷ আমরাও দেশের জন্য গর্ব অনুভব করি৷ তবে গত কয়েকবছর ধরে দেশজুড়ে অসহিষ্ণুতার আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে৷ আগামী সাধারণ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য৷ সংখ্যালঘু মানুষ সহিষ্ণুতার পক্ষেই রায় দেবে৷''
তবে বসে নেই ভারতীয় জনা পার্টি৷ ‘সংখ্যালঘুবিরোধী' তকমা ঝেড়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে তারা৷ সংখ্যালঘুদের কল্যাণে বেশকিছু প্রকল্প ঘোষণা হতে পারে নির্বাচনের প্রাক্কালে৷ তার মধ্যে অন্যতম হতে পারে প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান৷
ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অফ ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি জেনারেল বিশপ থিওডোরে ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে আমরা সবসময় দেশের মঙ্গল কামনা করে এসেছি৷ এখন আমরা ২০১৯-এর দিকে তাকিয়ে আছি৷ আমরা এমন একটা সরকার চাই, যারা অনগ্রসর, দলিত, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের দিকে বিশেষ নজর দেবে৷ ধর্মনিরপেক্ষতা অটুট রাখবে৷ সামাজিক বিভাজনে মদত না দিয়ে তা রুখবে৷ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হবে৷ তা সে যে রাজনৈতিক দলই হোক না কেন৷''
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ২ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত৷ এর মধ্যে মুসলিম ১৪ দশমিক ২ শতাংশ৷ বাকি ৬ শতাংশ শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈনসহ অন্যরা৷ পশ্চিমবঙ্গের আবার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত৷ এই রাজ্যে সংখ্যালঘুদের মন পেতে মরিয়া বিজেপি৷ গত মে মাসে রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৮৫০ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছিল তারা৷ উল্লেখযোগ্য সাফল্য মিলেছে৷ সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যেখানে যেমন, সেখানে তেমন নীতি নিয়ে এগোতে চাইছে তারা৷
দক্ষিণ দিল্লির বাসিন্দা শাহউদ্দিন কিন্তু মোটেই আতঙ্কিত নন৷ দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ তাঁর কন্ঠস্থ৷ তবু অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের সাক্ষাৎকার দেখে অনুপ্রাণিত তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘সংখ্যালঘুরা যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক! চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে৷ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সম্প্রীতির বুনন কেটে দিচ্ছে কিছু মানুষ৷ মরা (সংখ্যালঘুরা) ভয় পেলে ওরা (বিজেপি) আরো পেয়ে বসবে৷ এই দেশ আমাদেরও৷ মনে রাখতে হবে, নির্বাচনেই এদের জবাব দিতে হবে৷''