আসছে নির্বাচন, বাড়ছে সংখ্যালঘুদের আতঙ্ক
১২ নভেম্বর ২০১৮প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু দেশ ছাড়ছেন – এমন তথ্য উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক গবেষণায়৷ এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী দু-তিন দশকের মধ্যে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে৷ ২০১৬ সালের শেষভাগে এসে তিনি এই গবেষণা প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন৷ সেখানে দেখা যায়, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু দেশ ছেড়েছেন৷ ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি' শীর্ষক এই গবেষণায় ড. বারকাত দেখিয়েছেন, বিভিন্ন সময়কালে প্রতিদিন গড়ে নিরুদ্দেশ হওয়া হিন্দুদের সংখ্যা সমান নয়, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ – এই ৭ বছর প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৭০৫ জন হিন্দু, ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ – এই ১০ বছর নিরুদ্দেশের হার ৫২১ জন, ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হন ৪৩৮ জন, ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতিদিন ৭৬৭ হিন্দু দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আর ২০০১ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৬৭৪ জন হিন্দু দেশ ছেড়েছেন৷ পুরোটার গড় করে তিনি ৬৩২ জনের হিসাব দাঁড় করিয়েছেন৷
হিন্দুদের এমন বিপুল হারে দেশত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে দেশ ছাড়ার প্রবণতা তো দুই-তিন রকম হয়৷ নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রার উপর এগুলো নির্ভর করে৷ ২০০১ সালে নির্বাচনের পরে যে নির্যাতনটা হয়েছিল, তখন ধান ক্ষেতে মেয়েদের থাকতে হয়েছে৷ বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ এটা নিয়ে সাহাবুদ্দিন কমিশনের রিপোর্ট আমরা দেখেছি৷ তারপরও কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ আসলে যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ দেশে থাকতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি মাটি কামড়ে থাকার চেষ্টা করেন৷ শেষ পর্যন্ত না পারলে সবকিছু ফেলে, জন্মস্থান ছেড়ে চলে যান৷ তবে এটা সত্যি, নির্বাচনটা আমাদের জন্য সুখকর নয়৷ এবারও যে সুখকর হবে সেটাও বলা যাচ্ছে না৷ তেমন আলামত এখনও আমরা দেখিনি৷''
এমন আশঙ্কার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি যদি উলটো করে আপনাকে প্রশ্ন করি, কেন আশঙ্কা করব না? আমরা তো কোনো ব্যতিক্রম দেখছি না৷ একটা সুষ্ঠু ইলেকশন যদি হয়, তাহলে আমাদের উপর মারপিট অপক্ষাকৃত একটু কম হলেও হতে পারে৷ আমরা ইলেকশন কমিশনের সঙ্গে বসবো৷ তাদেরকেও বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করব৷ দেখেন, গত পাঁচ বছর আমাদের উপর যে হামলা হয়েছে, সেটার জন্য তো আমি বিএনপি-জামায়াতকে ওভাবে দায়ী করতে পারব না৷ তাহলে কে হামলা করেছে? এই সরকারের লোকজনই তো?''
কাজল দেবনাথের প্রশ্ন – ‘‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হিন্দু ছিল দেড় কোটি, ২০১৮ সালে এসে সেই সংখ্যা দেড় কোটি থেকে কত কমে গেছে, অথচ মুসলমান ৭১ সালে ছিল সাড়ে ৫ কোটি, এখন ১৪ কোটিরও বেশি, তাহলে কি হিন্দুদের সংখ্যা বাড়েনি? বাড়লে তারা গেল কোথায়?'' বাংলাদেশের আদম শুমারির দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী৷ ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ ভাগ, ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৫ ভাগ, ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী হিন্দু ছিল ১৩ দশমিক ৫ ভাগ, ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা হয় ১২ দশমিক ১ ভাগ, ১৯৯১ সালে ১০ দশমিক ৫ ভাগ, ২০০১ সালে ৯ দশমিক ২ ভাগ আর ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫ ভাগ হিন্দু৷ যদিও ২০১৪-১৫ সালে এসে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যে দেখা গেছে, দেশে হিন্দুদের সংখ্যা বেড়ে গেছে, অর্থাৎ ৮ দশমিক ৫ ভাগ থেকে সেটা হয়ে গেছে ১০ দশমিক ৭ ভাগ৷ প্রায় ১৫ লাখ হিন্দু বেড়েছে৷
সামনে নির্বাচন৷ ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে৷ এই পরিস্থিতিতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ৷ সেই সমাবেশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় দেশে সংখ্যালঘু ও উপজাতিদের ওপর আক্রমণের ঘটনা কমে এলেও হুমকি এখনও রয়ে গেছে৷ পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৮০ জনের ওপর আক্রমণ হয়েছে৷ ২০১৬ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর ১ হাজার ৪৭১টি হামলার ঘটনা ঘটেছিল৷ ২০১৭ সালে এই সংখ্যা কমে হয় ১ হাজার ৪টি৷এবার যেহেতু নির্বাচন, তাই হামলা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাঁর৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘৯০ এর পর থেকে, বিশেষ করে ২০০৮ সালের নির্বাচন ছাড়া যে নির্বাচনই হয়েছে, সেটা আমাদের কাছে কখনোই উৎসব হয়ে আসে না৷নির্বাচন আমাদের কাছে আসে ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে৷ আমরা দেখি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে মেলবন্ধন করে রাজনীতি করছে বা আপোশকামিতার মাধ্যমে রাজনীতি করছে৷ এর মধ্য দিয়ে আমরা বিপর্যয়ে পড়ব না এটা ভাবতে পারছি না৷ অতএব, এই সংকট নিয়েই আমরা আগামী নির্বাচনকে দেখছি৷''
দুর্গাপূজার সময় প্রধানমন্ত্রী হিন্দুদের উপহার হিসেবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমি ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ নির্বাচনের উপহার হিসেবে কি সংখ্যালঘুরা তাঁদের নিরাপত্তার স্বপ্ন দেখতে পারেন না? রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আসলে ঢাকেশ্বরী মন্দিদের জমি ২০ বিঘা৷ এর মধ্যে ১৩ বিঘাই দখল হয়ে গিয়েছিল৷ সেই ১৩ বিঘা জমি ফেরত দেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর জন্য মন্দির কর্তৃপক্ষকে ১০ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে৷ আমার জমি আমি ফেরত পেলাম, এর জন্য ১০ কোটি টাকা দিতে হলো৷ যদিও এটার নেগোসিয়েশনে প্রধানমন্ত্রীর একটা ভূমিকা আছে, সেটা আমি স্বীকার করি৷ কিন্তু এটা আমাদের ততটা আশ্বস্ত করতে পারেনি৷ এটা হয়ত নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগবে, কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না৷ দেখুন, ভারতবর্ষে সংখ্যালঘুদের বিকল্প আছে, কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কোনো বিকল্প নেই৷''
চলতি বছরের শুরুতেই সাংবাদিক সম্মেলন করে হিন্দু মহাজোট গেল বছরের নির্যাতনের একটা চিত্র তুলে ধরেছিল৷ সেখানে জোটের সভাপতি প্রভাস চন্দ্র রায় দেখিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে ১০৭ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে৷ আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৯৮৷ নিখোঁজ হয়েছেন ৩১ জন হিন্দু৷ আগের বছর সংখ্যাটা ছিল ২২৷ ২৫ জনকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে৷ মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে ২৩৫টি৷ সামনে যেহেতু নির্বাচন, তাই এবার এসব সংখ্যা আরো বেড়ে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা করেছেন নেতারা৷
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বা জামায়াত অংশ নেয়নি৷ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, নির্বাচনের পর আবার আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় এসেছে৷ তারপরও কেন হিন্দুদের উপর আক্রমণ হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে যশোর পূজা উৎযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর দাস রতন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত নির্বাচনের পর যশোরে তিনটি জায়গায় হিন্দুদের উপর মারাত্মক হামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে অভয়নগরের মালোপাড়ার কথা সবাই জানেন৷ ওই ঘটনার কিন্তু এখনও বিচার হয়নি৷ যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল, তারা সবাই ছাড়া পেয়ে গেছেন৷ ফলে সামনের নির্বাচন নিয়ে যশোর এলাকার হিন্দুরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমরা বারবারই দেখেছি, নির্বাচন এলেই হিন্দুরা আক্রান্ত হন৷ তবে একটা কথা বলে রাখি, এখানকার সবাই কিন্তু একটা নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য একটা প্রস্তুতির মধ্যেই আছেন৷''
আওয়ামী লীগের উপর কি তাহলে আপনাদের আস্থা কমে গেছে? জবাবে রতন বলেন, ‘‘দেখেন, আমরা যখন দেখি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, তখন খুবই হতাশ হই৷ একটা কথা মনে রাখতে হবে, আজ তিনি যাদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন, তারা যে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের বাক্স ভরে দেবে, সেটা কিন্তু মনে করার কোনো কারণ নেই৷ এ কারণেই আমরা অনেক বেশি হতাশ হয়েছি৷''
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু একটি পরিবারের ১১ জনকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে তালা মেরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়৷ ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়িতে না থাকায় ওই পরিবারের একজন সদস্য বেঁচে যান৷ তিনি গ্রাম্য চিকিৎসক বিমল কান্তি শীল৷ গত ১৫ বছর ধরে এই ঘটনার বিচারের জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন৷
ডয়চে ভেলেকে বিমল শীল বলেন, ‘‘আমি সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না৷ এটা রাজনৈতিক মামলা হয়ে গেছে৷ আমি কোনোভাবে মামলাটার গতি আনার চেষ্টা করলে, এটা রাজনৈতিক দিকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আমাদের যে জেলা পিপি সাহেব আছেন, তিনি এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না৷ এই ঘটনায় ২২ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল৷ তারা সবাই এখন জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ এর মধ্যে এসে গেছে নির্বাচন৷ ফলে আমার গ্রামের হিন্দুরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ আসলে কি করতে পারি? সরকার যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয়, তাহলে তো আমাদের কিছুই করার নেই৷ নির্বাচনের আগে-পরে জামায়াত-বিএনপি আমাদের উপর অনেকবার হামলা করেছে৷ কিন্তু সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগের যারা আছে, তারাও আমাদের সহযোগিতা করে না৷ ফলে আমাদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হবে – এটাই আমরা মেনে নিয়েছি৷''
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷