যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জীবন
১৯ এপ্রিল ২০২৪বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার সৌদি আরব। ২০২০-২১ অর্থ বছরে, অর্থাৎ করোনার সময়েও সেখান থেকে প্রবাসীরা ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠান। ২০২১ সালে চার লাখ ৫৭ হাজার, ২০২২ সালে ছয় লাখ ১২ হাজার এবং ২০২৩ সালে পাঁচ লাখ কর্মী সৌদি আরব যান। তিন বছরে প্রায় ১৬ লাখ কর্মী সৌদি আরবে গেলেও সেখান থেকে প্রবাসী আয় না বেড়ে উল্টো কমেছে। সৌদি আরব থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রবাসী আয় দুই বিলিয়ন ডলার কমে প্রবাসী আয় হয়েছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার । অন্যদিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রম বাজার আরব আমিরাত। গত ১০ বছর ধরে সেখানে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বলতে গেলে বন্ধ আছে। কিন্তু তারপরও সেখান থেকে প্রবাসী আয় এখন সৌদি আরবের চেয়ে বেশি আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১,৯৬৬.৯৫ মিলিয়ন ডলার। সেখানে আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৩,২৭০.৭২ মিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি জনশক্তি যে দেশে, সেই দেশের পরিস্থিতি এমন কেন জানতে চাইলে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, "সৌদি আরবে যারা যাচ্ছেন, তারা অদক্ষ শ্রমিক। ফলে তাদের বেতন অনেক কম। সংখ্যায় বেশি হলেও কম বেতনে কাজ করায় তাদের আয় কম।'' " আর তারা সেখানে যে কাজ করেন, তাকে আমরা বলি থ্রি ডি- ডার্টি, ডেঞ্জারাজ অ্যান্ড ডিফিকাল্ট। দক্ষতা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে এই কাজ করছেন। অনেক সময় দেখা যায় তারা খরচের টাকাই তুলতে পারেন না। আবার তুলতে হলে দীর্ঘ সময় লাগে,” বলেন তিনি।
আর অভিবাসন নিয়ে কাজ করা হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, "সৌদি আরব এখন তাদের নাগরিকদেরই ভালো কাজে নিয়োগ করছে। তাদের নাগরিকরা যেসব কাজ করতে চান না বা যেসব কাজে কায়িক পরিশ্রম বেশি, সেই কাজে বাংলাদেশিদের কম মজুরিতে নিয়োগ করছে তারা।”
এছাড়া নিয়োগকারীরা যে বেতনের কথা বলে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়ে যায়, পরে তার চেয়েও কম বেতন দেয় বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-র সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে কাজ নিয়ে সৌদি আরব যেতে এখন বিমান ভাড়াসহ সর্বোচ্চ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লাগার কথা। এর মধ্যে এজন্টদের সার্ভিস চার্জ, আকামা ফিসহ সব কিছুই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা খরচ হয়। এই অতিরিক্ত টাকা দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্টরা নানা অজুহাতে নেয়। আবার সৌদি আরবে যাওয়ার পর বেতনের একটি অংশ প্রতি মাসে ‘কফিল' নিয়ে নেয়। এত টাকা খরচ করে সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশের কর্মীরা শুরুতে ১০০০ থেকে ১২০০ রিয়ালে কাজ করতে বাধ্য হন।
২০২২ সালের অক্টোবরে সাত লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে যান সিরাজগঞ্জের ইউনুস আলী। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি কাজ না পেয়ে শেষে ২০২৩ সালের নভেম্বরে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। শেষ পর্যায়ে গাড়ি ধোয়া-মোছার কাজ করে উড়োজাহাজের টিকিটের টাকা জোগাড় করেন। তিনি বলেন, "ওখানে শুরুতে ১০০০ থেকে ১২০০ রিয়াল বেতন পাওয়া যায়। তার একটি অংশ আবার কফিলকে ( নিয়োগকারী) দিতে হয়। আর ওখানে এখন কনষ্ট্রাকশনসহ নিম্নমানের কাজ আছে বাংলাদেশিদের জন্য। সেগুলো অনেক কষ্টের কাজ হলেও বেতন খুবই কম।” তার কথা, "আমি ঋণ করে এবং সম্পদ বিক্রি করে সৌদি আরব গিয়ে এখন বিপদে আছি।”
বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, "এখনো মধ্যপ্রাচ্যই বাংলাদেশের কর্মীদের বড় গন্তব্য। দুবাই, কাতার এবং ওমানে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেয়া বন্ধ আছে। ফলে বাজার কিছুটা কমেছে। গত বছর আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩ লাখ লোক পাঠিয়েছি। তার মধ্যে পাঁচ লাখ গেছে সৌদি আরব। ”
তিনি বলেন, "এখন সেখানে সমস্যা হলো বাংলাদেশিদের অড জব করতে হয়। আর কিছু কিছু নিয়োগকর্তা যে বেতন বলে, তার চেয়ে কম দেয়। এটা নিয়ে আমরা শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা চাই দুই দেশ এটার একটা সমাধান বের করুক।”
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স ) ছিল ২৩.৭১ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২৩ সালে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২১,৯৪২.৭৬ মিলিয়ন ডলার। ওই সময়ে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ২,৯৭,১৩৮.১৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের মূল উৎস এখানো মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। সেখান থেকেই প্রবাসী আয়ের দুই তৃতীয়াংশ আসে। তার মধ্যে শীর্ষে আছে সৌদি আরব।
বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি করে। কিন্তু মোট প্রবাসী জনশক্তির ৩৫.৯৫ ভাগ আছে সৌদি আরবে। এরপর আরব আমিরাতে আছে ১৬.১৯ ভাগ, ওমানে ১১.৭২ ভাগ, কাতারে ৫.৬১ ভাগ, কুয়েতে ৪.২৯ ভাগ, বাহরাইনে ২.৫৫ ভাগ, লেবাননে ১. ৬৯ ভাগ ও জর্ডানে ১.৩৬ ভাগ। মধ্যপ্রাচ্যের এই আটটি দেশে বাংলাদেশের প্রবাসী জনশক্তির ৭৯.৩৬ ভাগ কাজ করেন।
১৯৭৬ সালে বিদেশে বাংলাদেশের ছয় হাজার ৮৭ জন কাজ করতেন। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট বিদেশে গিয়েছেন এক কোটি ৬০ লাখ ৭৫ হাজার। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪৫৩ জন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রথম লাখের ঘরে পৌঁছায়।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ মনে করেন, "এখন আমাদের সংখ্যা নয়, গুণগত মানের দিকে নজর দেয়া দরকার। দক্ষ কর্মী কম পাঠালেও তারা রেমিট্যান্স বেশি দেবে। বিএমইটি যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়, সেই প্রশিক্ষণ এখন আর কাজে লাগে না। প্রয়োজন একটি দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া।''
আর শরিফুল হাসান বলেন, "ফিলিপাইন্সও কিন্তু সৌদি আরবে জনশক্তি পাঠায়। সংখ্যায় অনেক কম। কিন্তু তারা দক্ষ জনশক্তি পাঠায়৷ তাই তাদের আয় অনেক বেশি। আমরা বছরে ১১-১২ লাখ অদক্ষ কর্মীর বদলে দক্ষ এক-দেড় লাখ কর্মী পাঠিয়ে এর চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আনতে পারি।”
বাংলাদেশের এখন এক কোটি লোক দেশের বাইরে কাজ করছেন। কিন্তু তাতে যত রেমিট্যান্স আসার কথা, তা আসছে না। আর গত বছর ১৩ লাখ লোক দেশের বাইরে গেলেও রেমিট্যান্সে সেই ঊর্ধ্বগতি নেই। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২.৫ শতাংশ। সরকার রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা দিলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাবার প্রবণতা তেমন বাড়ছে না। আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, "কার্ব মার্কেটে ডলারের যে রেট, তাতে শতকরা আড়াই-তিন টাকায় কী হবে? এছাড়া ব্যাংকের চার্জ আছে। যারা অবৈথভাবে হুন্ডির ব্যবসা করে তারা তো ডোর টু ডোর সার্ভিস দেয়। আর বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ আছে আন ডকুমেন্টেড। তারা তো আর ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে পারেন না।”
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে প্রণোদনা তেমন কাজে আসছে না। কারণ, ডলারের ব্যাংক রেট আর কার্ব মার্কেটে রেটের অনেক পার্থক্য। এছাড়া দেশে ও বাইরে হুন্ডি চক্র ব্যাপাকভাবে সক্রিয়। যারা অর্থ পাচার করতে চায়, তারা বেশি দাম দিয়ে দেশের বাইরে ডলার কিনে নেয়।”
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক মনে করেন, "কিছুটা হলেও এই প্রণোদনার প্রভাব পড়ছে। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন। তবে সেটা সন্তোষজন নয়।”
তিনি বলেন, "ক্যাশ ইনসেনটিভ ছাড়াও প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের মাধ্যমে তাদের নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আলাদা ব্যাংক করা হয়েছে। তারপরও নানা কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে প্রবাসীদের অর্থ থেকে যাচ্ছে।”