রক্ষকই যখন ভক্ষক – সরকারি কম্পিউটার ট্রোজান নিয়ে জার্মানিতে বিতর্ক
১২ অক্টোবর ২০১১আজকের যুগে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছাড়া এক পা এগোনো কঠিন৷ বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলিতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েই চলেছে৷ সবাই অবশ্য ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয়৷ অ্যান্টি ভাইরাস বা মৌলিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যারও ব্যবহার করেন না তারা৷ বা করলেও নিয়মিত আপডেট'এর তোয়াক্কা করেন না৷ তাদের সেই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে হ্যাকাররা ফাঁক ফোকর দিয়ে ভাইরাস, ওয়ার্ম, ট্রোজান হর্স কম্পিউটারে চালান করে দেয় এবং নানা অবৈধ উপায়ে মানুষের ক্ষতি করে৷ হ্যাকারদের চিহ্নিত করা বা করতে পারলেও তাদের নাগাল পাওয়া সহজ নয়৷ কম্পিউটারকে দুর্গ হিসেবে মনে করে তা মজবুত রেখেই এদের মোকাবিলা করা সম্ভব৷
কিন্তু সমস্যা হলো, হ্যাকারদের এই অবৈধ কার্যকলাপের পদ্ধতি রাষ্ট্রের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে৷ অপরাধী হিসেবে কাউকে সন্দেহ করলে পুলিশ তার বাড়িঘর বা দপ্তরে তল্লাশি চালাতে পারে, অবশ্যই আইনি কাঠামোর মধ্যে৷ কিন্তু এই সাইবার যুগে পুলিশের নজর কম্পিউটারের দিকেও৷ সেখানেই জমে রয়েছে অসংখ্য ‘ক্লু' বা যোগসূত্র৷ ই-মেল যোগাযোগ থেকে শুরু করে ফাইলের ভাণ্ডার – এসব ঘেঁটে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারলে পুলিশের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়৷ তবে সন্দেহভাজন ব্যক্তির মনে সন্দেহ জাগলে চলবে না৷ গোপনে তার বাড়িতে ঢুকে কম্পিউটার চালিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে বাড়ি ফিরে সে পুলিশের মতলব টের পেয়ে যেতে পারে৷ অতএব তল্লাশিও করতে হবে সাইবার পদ্ধতিতে৷ গ্রিক রূপকথার কাহিনীর মতো দুর্গের মধ্যে ট্রোজান হর্স পাঠিয়ে আঘাত হানতে চায় পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলি৷ কিন্তু পুলিশ হয়ে আবার আইনও ভাঙা যায় না৷ তাই প্রণয়ন করতে হয়েছে নতুন আইন৷ বিতর্কও অবশ্য কম হয় নি৷ সে আইনের কাঠামোর মধ্যে অনলাইন তল্লাশির উদ্যোগও শুরু হয়ে গেছে৷ কিন্তু এবার সর্ষের মধ্যেই ভুত পাওয়ায় শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক৷
জার্মানির একাধিক রাজ্য সরকার কম্পিউটার তল্লাশির জন্য অর্ডার দিয়ে ট্রোজান হর্স তৈরি করে ব্যবহার করছে৷ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে টেলিফোন করলে সেই সংলাপ বা সংলাপ সংক্রান্ত তথ্য জমা করছে এই ট্রোজান৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাবি করা হয় যে, তদন্তকারীরা নিয়ম-কানুন মেনেই দায়িত্বজ্ঞান দেখিয়ে এই কাজ করছেন৷ কিন্তু বাভেরিয়া সরকারের এক ট্রোজান আবার প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি সক্রিয় – তার প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় দেখা দিয়েছে বিতর্কের ঝড়৷ সেই ট্রোজান থেকে থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিনশট নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়, যা মোটেই আইনসঙ্গত কাজ নয়৷ চাপের মুখে পড়ে জার্মানির বিচারমন্ত্রী নতুন এক কর্তৃপক্ষ গঠনের অঙ্গীকার করেছেন, যার কাজ হবে রাষ্ট্রীয় স্তরে ট্রোজান বা অন্যান্য অনলাইন তল্লাশির উপকরণ ও পদ্ধতির উপর নজর রাখা, যাতে কোনো অবস্থায় আইন ভাঙা না হয়৷
যারা এই অনলাইন তল্লাশির কাজ করেন, সেই পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দপ্তরগুলিও নিজেদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছে৷ পুলিশ কর্মীদের সংগঠন স্পষ্ট আইনি কাঠামোর দাবি তুলেছে, যাতে তদন্তকারী কর্মীরা বর্তমান অস্পষ্টতার কারণে ফেঁসে না যান৷ ২০০৮ সালে জার্মানির সাংবিধানিক আদালত এক্ষেত্রে অত্যন্ত কড়া নিয়ম ও স্পষ্ট সীমা বেঁধে দিলেও দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কাজের ক্ষেত্রে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে৷
বাভেরিয়ার তদন্তকারীরা গত এপ্রিল মাস থেকে ৫ বার ট্রোজান ব্যবহার করে ই-মেল ও ইন্টারনেট টেলিফোন কলের পাশাপাশি হাজার-হাজার স্ক্রিনশট'ও সংগ্রহ করেছে৷ একটি ক্ষেত্রে ২৯,৫৮৯ স্ক্রিনশট জমা পড়েছে৷ অর্থাৎ সন্দেহভাজন ব্যবহারকারী মনিটরের পর্দায় যা কিছু দেখেছে, তার হুবহু স্থিরচিত্র পৌঁছে গেছে তদন্তকারীদের হাতে৷ প্রতিটি তদন্তের ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি সংগ্রহ করা হলেও অবৈধভাবে স্ক্রিনশট সংগ্রহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে৷ ‘ডিগিটাস্ক' নামের এক সংস্থাই মূলত এই সব ট্রোজান সরবরাহ করেছে৷ ফলে এই সংস্থার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে৷ এমনকি এই সংস্থার তৈরি আড়ি পাতার সফটওয়্যারের প্রযুক্তির মান নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছে এক মহল৷ নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলি একাধিকবার এই সংস্থার কার্যকলাপ সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছে৷ তাদের দাবি, ইচ্ছাকৃত ভাবেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে এই সংস্থা৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ