রবীন্দ্র সংগীত চর্চায় খারাপটা বয়ে চলে যাবে স্রোতের মত: সনজীদা খাতুন
৪ অক্টোবর ২০১১আজকের বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংগীতের আবহটিকে অনেকে মিলে আগলে রেখে লালন করে যাচ্ছেন৷ শিল্পী বেড়েছে৷ শিক্ষার্থী বেড়েছে৷ শহর পেরিয়ে তার প্রবেশ ঘটেছে মফস্বলে৷ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত বেরিয়ে আসছেন নতুন কোন শিল্পী৷ প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও রবীন্দ্রচর্চার এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সনজীদা খাতুন মনে করেন, রবীন্দ্র সংগীত কিছু বিত্তবান মানুষের মাঝে আর সীমিত নয়৷ তার আবেদন ছড়িয়ে আছে গ্রামে গঞ্জে৷
রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য শিলাইদহে এক অনুষ্ঠানের কথা স্মরণ করলেন সনজীদা৷ তাঁর কথায়, ‘‘সেই ৬৫ সালে যখন যুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে, সেই সময়ে - যুদ্ধের আগে আমরা শিলাইদহে গিয়ে গান করেছিলাম৷ ২২শে শ্রাবণ পালন করেছিলাম৷ আমরা জানতাম গ্রামের লোকে রবীন্দ্র সংগীত শোনেনা, পছন্দ করেনা৷ কিন্তু পাগলের মত এসেছিল সেদিন হাটের লোক৷ সেদিন হাটবার ছিল৷ এসে গান শুনেছিল তারা৷ এই পরিস্থিতিটা আমাদের দিনে দিনে বুঝিয়ে দিয়েছিল, রবীন্দ্র সংগীত কেবল উচ্চবিত্তের গান নয়৷ সেটা সবাই নিতে পারে৷ কারণ রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে এমন কিছু আছে, এমন লোক উপাদান আছে এবং আরো কিছু আছে, তার ভাষা এত সরল যে সাধারণ মানুষ তা নিতে পারে৷
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রবীন্দ্র সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে যেন বাঁধ ভেঙে যায়৷ তখন কোন ঝুঁকি নেই, কোন মানা নেই৷ আছে গাওয়ার সুযোগ এবং গানের কদর৷ ফলে গায়ক গায়িকার দল ভারি হতে লাগল৷ গান থাকল কিন্তু মান বোধহয় থাকলনা৷ এই অবস্থার কথাটাই জানালেন সনজীদা খাতুন৷ জানালেন, ‘‘বাংলাদেশ হবার পরে যে-না-সে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে আরম্ভ করেছিল৷ রবীন্দ্র সংগীত গাইলে বুঝি খুব আদৃত হবো৷ এই একটা বিশ্রী জিনিস হয়েছিল যাতে রবীন্দ্র সংগীতের গুনের কোন প্রকাশ পেতনা৷ তারপর আস্তে আস্তে চর্চা বেড়েছে৷ অনেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে শিখেছে৷ এখানে যারা থেকেছে তারাও যথেষ্ট যত্ন দিয়ে গান গেয়েছে৷ যেমন সদ্যপ্রয়াত বিলকিস নাসিরুদ্দিন৷ আমাদের - অত্যন্ত বয়স হয়ে গেছে এখন - মালেকা আজিম খান৷ আব্দুল আহাদ, কলিম শরাফী৷ এরা যেসব গান গেয়েছেন তার মধ্যে যে দরদ, তার মধ্যে যে রবীন্দ্র ভাবনার, রবীন্দ্র অনুভূতির যে গভীরতার প্রকাশ তার তো কোন তুলনা নেই৷ তার পরে যারা নতুন এল যেমন বন্যা অত্যন্ত আদৃত শিল্পী৷ পাপিয়া সারওয়ার তার আগের৷ কিন্তু সবার গান যে আমরা ভাল বলতে পারি তা নয়৷''
রবীন্দ্রসংগীতের এক ধরণের আধুনিকীকরণও চলছে ব্যান্ড সংগীত আর বিশেষ করে কলকাতার সিনেমার বদৌলতে৷ ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে' গানের মুখবন্ধে ‘ও লালা, ও লালা, ও লালারে' বলে নায়িকার সানন্দ চিৎকারও আজ রবীন্দ্র সংগীত অনুরাগীদের শুনতে হচ্ছে৷ এইযে পরীক্ষানিরীক্ষা, এটা কি রবীন্দ্র সংগীতের শুদ্ধতার জন্য ক্ষতিকর? সনজীদা খাতুন বললেন, ‘‘অদ্ভুত একটা আধুনিকতা ভর করেছে কলকাতার গানকে৷ মাথা নেড়ে নেড়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিশ্রী করে গান গায়৷ সেজন্য সবার গান যে পছন্দ করতে পারি তা না৷ কিন্তু অনেকেই রবীন্দ্র সংগীত ভাল গাইত৷ এখনও বন্যা গায়, মিতা হক আছে, লাইসা আহমদ লিসা আছে৷ এরকম অনেকেই এখন ভাল গাইছে৷ কিন্তু সবাই যে নির্বিশেষে ভাল গাইছে এমন বলা আমার পক্ষে কঠিন হবে৷ কারণ আমি শিক্ষক মানুষ তো, সবকিছুকে নিতে পারিনা৷ রবীন্দ্র সংগীত চর্চায় যেহেতু এখন বিশ্বভারতীর যে নিষেধাজ্ঞাটা ছিল যে যাখুশি তাই করবেনা, সেটা উঠে গেছে৷ সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন অনেকেই অনেক কিছু করে ফেলতে চেষ্টা করবে - কী ভারতে কী বাংলাদেশে৷ এই জিনিসগুলো আসবে একটা স্রোতের মত৷ সেই স্রোতটা চলে যাবে৷ আমাদের চারপাশে যারা সাধনা করছে তারা কিন্তু ঠিক জিনিসটাকে ধরে রাখবে৷ এটাতে আমার কোন সন্দেহ নেই৷ খারাপটা বয়ে চলে যাবে স্রোতের মত৷''
প্রতিবেদন: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন