রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি: সনজীদা খাতুন
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী, ঢাকার নবাব বাড়ির খাজা শাহাবুদ্দিন রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচারের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলেন, এই সংগীত পাকিস্তানের আদর্শের বিরোধী৷ ১৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এই নির্দেশনামার বিরোধিতা করে বিবৃতি দিলেন৷ এতে রবীন্দ্রনাথকে ‘বাংলাভাষী পাকিস্তানীর অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে' দাবি করা হয়৷ পাল্টা বিবৃতি দিলেন রবীন্দ্রবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিরা৷ এর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হল বুলবুল ললিতকলা কেন্দ্র বাফা, ছায়ানট, ক্রান্তির সম্মেলক অনুষ্ঠান৷ বইতে শুরু করল জোর রবীন্দ্র হাওয়া৷
উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরির নামে ঢাকায় বাফা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে৷ বাফায় রবীন্দ্র সংগীত শিখিয়েছেন কলিম শরাফী, ভক্তিময় সেনগুপ্ত এবং আরো পরে আতিকুল ইসলাম৷ তৎকালীন পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র সংগীতের চর্চায় বাফার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেন ছায়ানট প্রতিষ্ঠানের অন্যতম রূপকার সনজীদা খাতুন৷ তিনি বলেন: ‘‘বাফা রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা ভালভাবেই চালিয়ে গেছে সেইসময়৷ এমনকি শান্তিনিকেতন থেকে ‘শ্যামা' নৃত্যনাট্যের দল নিয়ে এসে তারা অনুষ্ঠান করেছে৷ কলকাতা থেকে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সুপ্রীতি ঘোষদের নিয়ে এসে তারা অনুষ্ঠানে গান গাইয়েছে৷ বাফার ভূমিকাটা তখন খুবই ভাল ছিল৷''
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের পরই গড়ে ওঠে সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে ‘ছায়ানট'৷ ঢাকায় রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের আবাহনী অনুষ্ঠান শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান৷ পাকিস্তান আমলে এগুলো ছিল প্রতিবাদেরই প্রকাশ৷ এই প্রতিবাদের শরিক হয় ছোটবড় আরো সাংস্কৃতিক সংগঠন৷ আন্দোলনের নানা পর্বে নানা অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান৷ সনজীদা খাতুন বললেন: ‘‘সোনার বাংলা গাওয়া হয়েছে মিছিলে৷ অনুষ্ঠান হলে সেখানে ‘সার্থক জনম আমার' গাওয়া হয়েছে৷ একটি গান আমরা আবিষ্কার করেছিলাম৷ ‘কে এসে যায় ফিরে ফিরে আকুল নয়ননীরে৷ কে বৃথা আশাভরে চাহিছে মুখ'পরে, সে যে আমার জননী রে৷' তার পরের কথাগুলো ইম্পর্টেন্ট৷ ‘কাহার সুধাময়ী বাণী মিলায় অনাদর মানি৷ কাহার ভাষা হায় ভুলিতে সবে চায়, সে যে আমার জননীরে৷' এই যে গানটা, এটা রবীন্দ্রনাথ বহু আগে বাংলায় যে বক্তৃতা হত না তা নিয়ে দুঃখ করে গানটা লিখেছিলেন৷ আর আমরা ভাষা আন্দোলনের পরে এই গানটা নতুন করে আবিষ্কার করলাম৷ এই গান আমরা তখন গাইতাম৷ তাছাড়াও পাকিস্তান আমলে আমরা যেটা করেছি, যখনই কোন একটা বিরূপ ব্যাপার হত তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে আমাদের মনের ব্যথাটা প্রকাশ করতাম৷ যারা দর্শক হয়ে আসতেন তারা কিন্তু বুঝতে পারতেন৷ একটা অনুষ্ঠানে আমরা গেয়েছিলাম -‘কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো! বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো৷' অন্ধকারের মধ্যে গানটা শুরু করা হয়েছিল৷ এবং সেটা বিশেষভাবে মানুষের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল৷ তাছাড়া একবার পাকিস্তান আমলে, আইউবের আমলে চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের গ্রামে শিশুনারী নির্বিশেষে মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছিল৷ আর্মি গিয়ে করেছিল৷ সেই সময় বৌদ্ধরা কয়েকজন আমাদের কাছে এসেছিলেন৷ বললেন, আমরা কিছুতো করতে পারছিনা, কিছু বলতে পারছি না৷ আমরা রবীন্দ্র সংগীতের একটা অনুষ্ঠান করতে চাই৷‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী', বুদ্ধকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু গান আছে সেই গানগুলো, সেসময় তারা আমাদের কাছে দেখে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছিলেন৷ এটাও আন্দোলনই হলো৷''
মুক্তিযুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথের গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নানা উদ্দীপক গানের সঙ্গে প্রচারিত হয় রবীন্দ্রনাথের গান৷ সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক এঁদের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে গানের দল৷ তাঁরা ঘুরে বেড়ান মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে৷ সনজীদা খাতুন জানালেন: ‘‘আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল কলকাতায়৷ সেখানে গিয়ে আমরা ‘রূপান্তরের গান' নামে একটি গীতি আলেখ্য তৈরি করেছিলাম৷ তাতে ‘সার্থক জনম আমার' ছিল৷ ‘সোনার বাংলা' তো ছিলই৷ আরো গান ছিল৷ ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে, নগরে প্রান্তরে বনে বনে৷ অশ্রু ঝরে দু নয়নে, পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে৷' কিংবা আরেকটা গান ছিল - ‘ঢাকোরে মুখ চন্দ্রমা, জলদে'৷ মানে চাঁদকে বলা হচ্ছে মুখ ঢেকে ফেলো, বড় লজ্জার দিন, বড় কষ্টের দিন, দুঃখের দিন৷ এই গানগুলোকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করে তখন গাইতাম৷ এবং এই গান হতো মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থীদের শিবিরে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে সাধারণ মানুষকে আমাদের বেদনার সাথে যুক্ত করবার জন্য আমরা এই গানগুলো গাইতাম৷ কাজেই রবীন্দ্র সংগীত আমাদের আন্দোলনের মস্তবড় একটা হাতিয়ার ছিল এবং এখনও আছে৷ এখনও আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি৷''
প্রতিবেদন: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন