রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল আমদানি কতটা সম্ভব?
২০ আগস্ট ২০২২গত মে মাসে প্রথম রাশিয়া বাংলাদেশে জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রস্তাব দেয়৷ তবে দুই সপ্তাহ আগে ফের প্রস্তাব দিলে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে৷ এরই মধ্যে তাদের প্রস্তাব খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটিও গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন(বিপিসি)৷ প্রথমবার মে মাসে প্রস্তাবের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘রাশিয়ার তেল শোধনের উপযোগী রিফাইনারি বাংলাদেশে নাই৷ আর এ ধরনের প্ল্যান্ট করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর লেগে যাবে৷’’ কিন্তু রাশিয়া এখন পরিশোধিত তেল রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে এবং তা অনেক কম দামে৷
বিপিসির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে৷ এ সময় অপরিশোধিত তেল এসেছে আট লাখ ৭০ হাজার টন৷ বাংলাদেশ মূলত অপরিশোধিত তেল কেনে সৌদি আরবের সৌদি আরামকো এবং আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি থেকে৷ আর পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের আটটি কোম্পানি থেকে৷ এর মধ্যে চীনের কোম্পানি দুটি৷
ইস্টার্ন রিফাইনারির এরকজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের শোধনাগারে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা সম্ভব নয়৷ কারণ এর ঘনত্ব মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের তুলনায় বেশি৷ পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সংবাদমাধ্যমেকে বলেছেন, ‘‘শোধনের বিষয়টি দেখতে রুশ বিশেষজ্ঞরা শিগগিরই বাংলাদেশে আসছেন৷ তারা স্থানীয় শোধনাগারগুলি পরিদর্শন করে এখানে রাশিয়ান তেল পরিশোধনের উপায় বের করবেন৷ এরপর আমরা সেগুলি সংস্কারের উদ্যোগ নেব৷ তবে এটাকে প্রধান বাধা মনে করা হচ্ছেনা৷ কারণ বিকল্প ব্যবস্থা আছে৷ রিফাইন করা জ্বালানি তেল আনা যায়৷ আবার তৃতীয় কোনো দেশেও রিফাইন করা যায়৷ কিন্তু বড় বাধা হলো ইউক্রেন আক্রমণের কারণে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা৷ আর বাংলাদেশ কীভাবে তেলের অর্থ পরিশোধ করবে তার উপায় বের করা৷’’
রাশিয়ার প্রস্তাব:
‘হিউজটন’ নামে একটি কোম্পানি রাশিয়ার পরিশোধিত ডিজেল বিক্রির প্রস্তাব জমা দিয়েছে মন্ত্রণালয়ে৷ তারা প্রতি ব্যারেল ৫৭ টাকা দর দিয়েছে৷ প্রতি লিটারের দাম পড়বে ৪০ টাকার কম৷ তেল জাহাজে পাঠানো হবে দুবাই থেকে৷ এছাড়া প্রতি টন রাশিয়ান ডিজেল ৪২৫ ইউএস ডলারে দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে আরেকটি প্রতিষ্ঠান৷ তাতে প্রতি ব্যারেলের (১৫৯ লিটার) দাম পড়ে ৫৭ দশমিক ৪৩ ডলার ৷ ডলার ১১০ টাকা হিসেবে ধরলে প্রতি লিটারের আমদানি খরচ পড়বে ৪০ টাকার কম৷
অন্যদিকে বাংলাদেশের কাছে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেল ৫৯ ডলারে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রসনেফট অয়েল৷ প্রতিষ্ঠানটি এই দরে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে৷ বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সংকট চলছে৷ বিশ্ব বাজারে এর দাম কমলেও বাংলাদেশে এখনো উচ্চমূল্যেই বিক্রি হচ্ছে৷ চলতি মাসেই নজিরবিহীনভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে৷ এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে৷ বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা করা হয়েছে৷ পেট্রোলের দাম ৫১.৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার৷ অকটেনের দাম ৫১.৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা লিটার৷
রাশিয়া থেতে তেল আমদানি করতে পারলে বাংলাদেশ এই জটিল পরিস্থিতি ধেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমাদনি করলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের(ইইউ) প্রতিক্রিয়া কী হবে৷ কারণ ওই সব দেশে বাংলাদেশ ৩৫-৪০ বিলিয়নের পণ্য রপ্তানি করে৷ যার মধ্যে তৈরি পোশাকই প্রধান৷
বাংলা কি পারবে রাশিয়ার তেল আনতে?
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম মনে করেন রাশিয়ার তেল আমদানিতে কতগুলো ইস্যু আছে৷
সেগুলি হলো,
১.পেমেন্ট কীভাবে করা হবে৷ ডলার নিয়ে সমস্যা আছে৷ ২. রাশিয়া কতখানি ছাড় বা ডিসকাউন্ট দেবে৷ ৩. প্রোডাক্ট না ক্রুড অয়েল আনা হবে৷ ৪. ক্রুড আনলে সেটা প্রসেস করতে রিফাইনারির অনেক পরিবর্তন আনতে হবে৷ তাতে কত দিন সময় লাগবে ৷ খরচ কত পড়বে৷ ৫. ক্রুড থেকে কতখানি সেভিংস হবে- এরকম আরো অনেক বিষয় আছে৷ এখন কমিটি সেগুলো দেখছে৷ কমিটি প্রতিবেদন দিলে বোঝা যাবে৷
তিনি বলেন, ‘‘ক্রুডের ব্যাপারে আমি বেশি একটা আশাবাদী নয়৷ তবে যদি রিফাইন জ্বালানি আনা যায় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে৷ যদি ফিনিশড ডিজেল আনতে পারি, সেটা যদি ডিসকাউন্টে দেয় ট্রান্সপোর্ট কস্টসহ তাহলে সেটা আমাদের জন্য লাভজনক হবে৷''
নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমাদের কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চাপে আছে৷ ভারতকে তো রেহাই দেয়া হয়েছে৷ সেটা যদি আমিরা বুঝাতে পারি তাহলে হবে৷ এটা অসম্ভব কিছু নয়৷''
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমাদের আনতে হবে রিফাইনড অয়েল৷ ক্রুড এনে আমাদের লাভ নেই৷ কারণ ক্রুড প্রসেস করা মত আমাদের সক্ষমতা নাই৷ রাশিয়া সর্বশেষ প্রস্তাবে রিফাইনড অয়েল রপ্তানির কথা বলেছে৷ সেটা আমাদের জন্য সুযোগ৷''
তবে এখানে আরো কয়েকটি বিষয় আছে সেগুলো কীভাবে সেটেলড করা হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রাশিয়ার সঙ্গে একটা বিনিময় চুক্তি করতে হবে৷পেমেন্টটা আমরা কীভাবে দেব সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা ডলারে সুইফট সিস্টেমে দিতে পারবনা৷ সেক্ষেত্রে চীনা মুদ্রা একটি বিকল্প হতে পারে৷ আর চাইলেও রুবলেদেয়া যাবেনা৷ কারণ রুবল পাওয়া যাবেনা৷ আরেকভাবে হতে পারে৷ আমরা যে এক্সপোর্ট করি তার মাধ্যমেও সরাসরি দিতে পারি৷''
তার মতে, ‘‘আমরা তো আর ভারতের মতো পারবনা৷ ভারতের শক্তি আছে তাই সে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল আনছে৷ আর শেষ পর্যন্ত তাকে আইন পরিবর্তন করে রেহাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ আমাদের কূটনৈতিক পর্যায়ে বুঝাতে হবে যে আমরা ক্রাইসিস-এ আছি৷ সেটা বোঝানো গেলে তারা ওভারলুক করতে পারে৷''