‘গুরুতর অসদাচরনে’ লিপ্ত নির্বাচন কমিশন
১৯ ডিসেম্বর ২০২০৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক চিঠিটি পাঠিয়েছেন৷ রাষ্ট্রপতিকে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের অনুরোধ করেছেন তারা৷ পাশাপাশি অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকারও অনুরোধ করা হয়েছে৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, তারা আইনের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করেছেন৷ অভিযোগের বিষয়ে এখন রাষ্ট্রপতিই সিদ্ধান্ত নিবেন৷
‘অভিশংসনযোগ্য অপরাধ’
শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে নিজেদের অভিযোগের বিষয় তুলে ধরেছেন শাহদীন মালিকসহ কয়েকজন৷ পরে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘আমরা সবাই মনে করেছি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে, সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ৷ সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার কথা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের৷ দুদক বা পুলিশ এটা করতে পারবে না৷ রাষ্ট্রপতি এ নির্দেশ দিতে পারেন৷ এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে অভিযোগ জানিয়েছি৷ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত হওয়া উচিত৷ আমরা আশা করছি, গুরুতর অসদাচরণের দায়ে তারা দোষী হবেন৷ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের অপসারণ করবেন৷’’
গত ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো চিঠিতে অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলী খান, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, ড. হামিদা হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, খুশী কবির, অধ্যাপক পারভীন হাসান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ড. আহসান মনসুর, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, শামসুল হুদা, অধ্যাপক সি. আর আবরার, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ ৪২ জন স্বাক্ষর করেছেন৷
চিঠিতে বলা হয়েছে, কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচারণে লিপ্ত হয়েছেন৷ কমিশনের সদস্যগণ একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ৷ একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন৷ ‘‘আমরা আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মসহ কমিশনের গুরুতর অসদাচরণের অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে আপনার সদয় অবগতির জন্য চিহ্নিত করছি৷’’
যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে
- অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম৷
- নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম৷
- নিয়ম বহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম৷
- এছাড়া ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ), খুলনা, গাজীপুর, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷
অভিযোগকারীরা যা বলছেন
এতদিন পরে কেন এই অভিযোগ সামনে আনলেন, জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংবিধানিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চাইলেই অভিযোগ করা যায় না৷ আমরা যারা এখানে স্বাক্ষর করেছি, তারা বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করি৷ নিজেরা কিছু কাজ করেছি৷ পাশাপাশি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়েও কাজ হয়েছে৷ এই কাজগুলো করতে একটু সময় লেগেছে৷’’
শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘নিয়োগে যে দুর্নীতির কথা আমরা বলেছি, সেটা তো একজন নির্বাচন কমিশনার নিজেই অভিযোগ করেছেন৷ ফলে এটার তদন্ত হওয়া জরুরি৷ সাংবিধানিকভাবে একজন কমিশনার দু'টি করে গাড়ি প্রাপ্ত হন৷ গত জুলাই মাসে তাদের প্রত্যেককে দু'টি করে নতুন গাড়ি দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু তিন জন কমিশনার আগের দু'টি গাড়ির মধ্যে একটি ফেরত দিয়েছেন৷ অর্থাৎ নতুন দু'টি গাড়ির সঙ্গে তারা আগের একটি রেখে দিয়েছেন৷ এতে কমিশনের অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়েছে৷ এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের পর তারা যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে দেশের মানুষ তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেবেন৷
আরেকটি বিষয় হল, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২১৫টি আসনে শতভাগ ভোট পড়েছে৷ সাড়ে চারশ' কেন্দ্রে ৯৫ শতাংশের উপর ভোট পড়েছে, সেখানে নৌকা ছাড়া আর কোন প্রতীকে ভোট পড়েনি৷ এটা তো হতে পারে না৷ আমরা কেউ রাজনীতি করি না, কিন্তু বিষয়গুলো আমাদের ভালো লাগেনি৷’’
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সচেতন মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রের অভিভাবক রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগটি করেছি৷ আমরা তো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখি না৷ পাশাপাশি দেশের মানুষও জানতে পারল বিষয়টি৷ এখন রাষ্ট্রপতি যদি গুরুত্ব দেন তাহলে তদন্ত হবে৷ পাশাপাশি আমাদের এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এক ধরনের জনমতও সৃষ্টি হয়েছে৷ ফলে নির্বাচন কমিশনাররা যা ইচ্ছে তাই করে চলতে পারবেন না৷ আসলে সকলের জবাবদিহিতা থাকা উচিত৷’’
নির্বাচন কমিশন যা বলছে
চিঠির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনরের বক্তব্যের জন্য ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে কমিশনারে রফিকুল ইসলাম এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছেন, ফলে রাষ্ট্রপতিই সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি কী করবেন৷ তিনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করবেন৷’’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন হলে আপনাদের কোন আপত্তি আছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি যেটা ভালো বুঝবেন সেটা করবেন৷’’ আপনারা কি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘অবশ্যই আমরা আইনের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি৷’’