রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
১৯ ডিসেম্বর ২০১৭রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ৷ বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও৷ বন উজার হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা৷ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে৷ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে৷ না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে৷
রয়েছে এইডস, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৯৭ জন এইচআইভি পজেটিভ৷ ফলে ওই অঞ্চলে এইডস-এর ঝুঁকি বাড়ছে৷ তাই এইচআইভি ছড়ানো ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার৷ গত ২৫ আগস্ট থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা৷ নতুন আর পুরোনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস৷
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুস সালাম বলেন, ‘‘এইডস রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে৷ প্রতিদিনই এইডস-এ আক্রান্ত তিন-চারজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন৷'' তাঁর কথায়, ‘‘পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৯২ জন আগে থেকেই আক্রান্ত ছিলেন৷ নতুন করে চিহ্নিত হয়েছেন পাঁচজন৷ এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করতে টেকনাফ ও উখিয়ায় দু'টি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে৷ সাধারণ রোগের চিকিৎসায় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে অনেকের শরীরে এইডস পাওয়া গেছে৷ তবে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় অনেকের রক্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না৷''
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ ফলে স্থানীয় লোকজনের চিকিৎসাসেবা পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে৷ তার ওপর রোহিঙ্গারা যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছেন৷ ফলে পানিবাহিত রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে৷ আসলে এখনও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ করা যায়নি৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ অবশ্যই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে৷ আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাঁরা বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ে এসেছেন৷ রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে৷ কারণ দুই লাখ মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি, সেখানে ৭ থেকে ৯ লাখ মানুষের সেবা দিতে হচ্ছে৷ আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে, পোলিও টিকা ছাড়া তাঁরা কোনো ধরনের টিকা পাননি৷ তাই আমাদের শিশুদের জন্য রাখা হাম-রুবেলার টিকা রোহিঙ্গা শিশুদের দেয়া হয়েছে৷ কারণ হাম একবার দেখা দিলে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ তাছাড়া মিয়ানমারে কলেরা সমস্যা রয়েছে৷ তাই সংকটকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মজুদ ১০ লাখ টিকার ৯ লাখই রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছে৷
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক চাপে পড়বে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা৷ কিন্তু আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই৷ জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা৷ বর্তমানে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি এই সাহায্য অব্যহত থাকবে সেটা বলা মুশকিল৷ যখন পাওয়া যাবে না তখন বাংলাদেশকেই এই টাকা খরচ করতে হবে৷
রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়তে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়৷ সেজন্য সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে৷ এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে৷ আর এই ব্যয়টা খরচ হচ্ছে বাজেট থেকে৷ অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা না থাকলে এই টাকা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত৷ সেটা করা গেলে দেশের কিছু মানুষ তো অন্তত ভালো থাকত!''
তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ খুব বড় ধরনের চাপে পড়বে না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের ওই এলাকা থেকে বাইরে আসতে না দিলে ভালো হবে৷ তাঁদের জন্য আমাদের বড় আকারে সাহায্য দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেই আমরা এই খরচগুলো পাব৷ তবে তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতসহ অন্যান্য কাজে আমাদের কিছু লোকবল ওখানে দেয়া লেগেছে৷ সেজন্য প্রশাসনিক ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে৷''
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন স্থানীয় নাগরিকরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন৷ দিন দিন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠছে৷ এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ জরুরি৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে দেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে৷ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একসময় এ সব ভুলে যাবে৷ অন্য সমস্যার ভিড়ে তখন এটা ক্ষুদ্র ইস্যুতে পরিণত হবে৷
জানা গেছে, ওই এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে৷ ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ নিয়ম অনুযায়ী আশ্রিতরা কোনো কাজে নিয়োজিত হতে পারবে না, কিন্তু তারা অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লবণ মাঠ, চিংড়ি হ্যাচারি, চাষাবাদের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়েছে৷ এতে স্থানীয় দরিদ্র শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে৷ উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে শিক্ষাব্যবস্থা একদম ভেঙে পড়েছে৷ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন৷ সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকেরও কম৷ স্থানীয় কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মী যোগাতে অনেক রোহিঙ্গা যুবককে কাছে টানছে বলেও অভিযোগ আছে৷ রোহিঙ্গারা যদি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে৷
তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ এর জন্য তাঁরা দেশীয় দালালদের সহায়তায় ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছেন৷ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন জানান, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি, মাত্র ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) পাচ্ছে রোহিঙ্গারা৷ এভাবে এনআইডি নিয়ে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে৷'' তিনি বলেন, কোনো সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না৷ ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা তরুণরা সপ্তাহে একদিন রেশন তুলবে আর বাকি দিনগুলো বসে থাকবে, তা হবে না৷ তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দেবে৷ তারা ক্যাম্প থেকে গোপনে বেরিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে৷
কক্সবাজারে পর্যটনে ধস নামার আশঙ্কা
রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ধস নামার আশঙ্কা আছে৷ এখনই রোহিঙ্গা নারীদের কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা করতে দেখেছেন অনেকে৷ দেহ ব্যবসায়ও অনেক নারীকে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে৷ এ নিয়ে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন প্রশাসনও৷ এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারকে অনেকেই পাশ কাটিয়ে অন্য পর্যটনকেন্দ্রে চলে যেতে পারেন৷ এমনটা হলে কক্সবাজারের পর্যটনে ভয়াবহ ধস নামতে পারে৷
কক্সবাজারের প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারে সাড়ে তিনশ' হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজ রয়েছে৷ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের অনেককেই হোটেল-মোটেলে দেহব্যবসায় পাওয়া যাচ্ছে৷ এঁদের মধ্যে এইডস আক্রান্তরাও রয়েছেন৷ তাঁদের সঙ্গে পর্যটকসহ হোটেল-মোটেল শ্রমিকদের শারীরিক মেলামেশায় বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অনেকে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ায় দেশে এইডস ছড়ানোর আশঙ্কা আছে৷
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় তাঁরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন৷ এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের কাছেও তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন৷ পুরনো রোহিঙ্গারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ' করে নানা রকম অবৈধ ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছেন৷ কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ৷ অভাব অনটনে পড়া রোহিঙ্গা নারীরা যদি কক্সবাজারে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অনেকেই সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন৷ এমনকি দেশের মানুষও পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে অনাগ্রহ দেখাবেন৷
রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি
বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কট্টরপন্থি মনোভাবাপন্ন যুবকদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন৷ এত বেকার যুবকের মধ্যে হতাশা কাজ করা স্বাভাবিক৷ জঙ্গি সংগঠনগুলো এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে৷ মৌলবাদী দলগুলোও যে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, এমন তথ্যের কথা জানিয়েছেন গোয়েন্দারা৷ রোহিঙ্গা যুবকরা মাদক পাচারে আগে থেকেই জড়িত৷ বাংলাদেশে ইয়াবা যা ঢোকে তার ৯০ ভাগই মিয়ানমার থেকে৷ ইয়াবা এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা৷ তাঁদের এ সব কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে এ দেশের কিছু মানুষ৷ অভিযোগ রয়েছে, এবারও পালিয়ে আসার সময় অনেক রোহিঙ্গা সঙ্গে করে কিছু ইয়াবাও এনেছেন৷ তাঁরা যখন দলে দলে এখানে ঢোকেন, তখন তাঁদের তল্লাশি করে ঢোকানোর কোনো সুযোগ ছিল না৷
নিরাপত্তা বিশেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বলা হচ্ছে আরসার ২০০ সদস্য দা-কুড়াল এবং কিছু ছোট অস্ত্র নিয়ে একই সময়ে সেনা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছে৷ আমার যতটুকু সামরিক জ্ঞান আছে, তাতে মনে হচ্ছে, অত অল্পসংখ্যক মানুষের, এত কম সময়ে একটা নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হামলা চালানো কিছুতেই সম্ভব নয়৷ বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিতে তারা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) তাদের লোক দিয়ে এ হামলা করিয়েছে কিনা, সেটা চিন্তা করতে হবে৷'' তিনি বলেন, প্রচুরসংখ্যক ৯-১০ বছরের শিশু কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে৷ যাদের সামনে বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে এবং বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ তারা এক সময়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে৷ তেমনটা হলে এটা শুধু মিয়ানমারের জন্যই নয়, আশ্রয়দাতা দেশের জন্যও নেতিবাচক হতে পারে৷ তাই ওইসব শিশুর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে৷
পাহাড়-বনের অপূরণীয় ক্ষতি
কক্সবাজারের উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দু'পাশে কালো রঙের পলিথিন দিয়ে বানানো হয়েছে শত শত ঝুপড়িঘর৷ যতদূর চোখ যায় একই চিত্র৷ পাহাড়-বনাঞ্চল এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না৷ পাহাড়গুলো কেটে এই ঝুপড়িঘরগুলো বানানো হয়েছে৷ বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি করা হয়েছে৷ এই ঝুপড়িঘরগুলো রোহিঙ্গারা নিজেরাই তৈরি করেছে৷ ফলে ওই এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ধসে পড়তে পারে পাহাড়৷ এতে বহু মানুষ হতাহতের আশঙ্কাও করা হচ্ছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি৷ কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল৷ এক সময় হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়ত গাছও লাগানো যাবে, কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না৷ অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে তো আর পাহাড়ের কাটা জায়গা পূরণ করা যাবে না৷ এই পাহাড়গুলো ১৫-২০ মিলিয়ন বছরের (দেড় থেকে দু'কোটি বছর) পুরনো৷ পাহাড়গুলো কাটার ফলে এখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মধ্যে পানি ঢুকে পড়বে৷ এতে যে কোনো সময় পাহাড় ধসে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে৷ ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই৷ আর যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে৷ এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের এই ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না৷
কক্সবাজার জেলা বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির জানান, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে৷ এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে৷
কক্সবাজার এলাকার পাহাড় ও বন নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া৷ এই অধ্যাপক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ সবাইকে রান্না করে খেতে হচ্ছে৷ এক লক্ষ চুলা যদি থাকে, সেই এক লক্ষ চুলার জন্য প্রতিদিন যদি ন্যূনতম পাঁচ কেজি জ্বালানি ধরি, তাহলে প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ কেজি কাঠ পুড়ছে৷ এগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের উখিয়া টেকনাফের জঙ্গল থেকে যাচ্ছে৷ এই অবস্থা অব্যহত থাকলে বনভূমির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে৷''
স্থানীয় পরিবেশবাদীদের হিসাব অনুসারে, পাহাড়ের আশেপাশের জায়গা ধরলে রোহিঙ্গাদের বস্তির জায়গার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর৷ এই বিপুল পরিমাণে পাহাড় কাটায় এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা৷ যে কোনো সময় বড় রকমের পাহাড়ধস ঘটার আশঙ্কায় তাঁরা উদ্বিগ্ন৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷