1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে লোকগান বেঁচে আছে শিল্পীদের চিরায়ত জীবনচর্যায়

৩ অক্টোবর ২০১৭

লোকগানের ধারা, শব্দপ্রয়োগ ও যন্ত্রানুষঙ্গে এখন অনেকটাই আধুনিক৷ প্রচলিত কথা ও সুরে তৈরি হওয়া লোকগান গাওয়া হচ্ছে ভিন্ন আঙ্গিকে৷ এ পরিস্থিতিতে  পশ্চিমবঙ্গে লোকগীতির অবস্থা জানিয়েছেন সেখানকার সংগীতকার, গবেষক ও সংগঠক৷

https://p.dw.com/p/2l6iC
Bengalische Volkslieder
ছবি: DW/P. Samanta

লোক সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক শুভেন্দু মাইতি এটা মানছেন, পণ্যায়নের সংস্কৃতি লোকগানের শুদ্ধতাকে নষ্ট করেছে৷ কয়েক দশক ধরে বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঘর করা এই মানুষটি শিল্পীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কী জন্য গানটা গাওয়া হচ্ছে সেটাই বড় ব্যাপার৷ যদি কেউ বাণিজ্যিক কারণে গান, তাহলে বাড়তি কিছু সংযোজন করতে হয় ব্যবসায়িক স্বার্থে৷ গ্রামে যে শিল্পী গাইছেন, তাঁর এই সমস্যা নেই৷ সুতরাং সংকট কিছু থাকলে সেটা শহরে রয়েছে৷'' তাহলে কি এই বাড়তি সংযোজনে লোকগানের শুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে না? শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘লোকসংগীতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে৷ লোকসংগীত অনেকটা আটপৌরে মা৷ সেই আটপৌরে মা-কে বাজারে বেচবার জন্য যদি জিনস-টপ পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তার শুদ্ধতা তো নষ্ট হবেই৷''

গানের শুদ্ধতা যে নষ্ট হচ্ছে, একথা মেনে নিয়েছেন ‘দোহার'-এর প্রাক্তন সদস্য মানব ঘোষ৷ তাঁর মতে, ‘‘আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গ লোকগানে মিশিয়ে দেওয়ার ভালো ও খারাপ দুটি দিকই আছে৷ অনেকের কাছে গানটা পৌঁছে যাচ্ছে, শ্রোতারা মূল গানটি খুঁজতে আগ্রহী হচ্ছেন, এতে বিক্রি বাড়ছে৷ তাতে গান বিকৃতও হচ্ছে৷ রাধাকৃষ্ণের প্রেমগীতির সঙ্গে ড্রাম বা গিটার বাজানো হচ্ছে, যা কাম্য নয়৷''

তবে এই সমস্যা অতিক্রম করা অনেকটাই সম্ভব বলে মানব ঘোষ মনে করেন৷ কীভাবে? তাঁর বক্তব্য, ‘‘লোকগান গুরুমুখী বিদ্যার অধীন৷ এটা ঠিকঠাক করে শেখা দরকার৷ যদিও কন্ঠস্বরের আঙ্গিক নকল করা সম্ভব নয়৷ তাই কোনও ভূমিপুত্র ভাওয়াইয়া বা ঝুমুর গাইলে যেমন শোনাবে, আমরা সেটা পারব না৷ তবে আমাদের সেটা যতটা সম্ভব শিখে গাইতে হবে৷''

মাইতি

লোক সঙ্গীত জগতে বাণিজ্যের প্রবল তাড়নার কথা স্বীকার করেছেন শিল্পী মানব ঘোষ৷ মেনে নিয়েছেন, সে কারণেই এ রাজ্যে ওপার বাংলার রথীন্দ্রনাথ রায়ের তুলনায় আনুশেহদের ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা বেশি৷ তরুণ প্রজন্মের কাছে আধুনিক লোকগান পৌঁছে যাচ্ছে মার্কেটিং আর প্রচারের জোরে৷ আবার অতীতে নির্মলেন্দু চৌধুরী, অভিজিৎ বসু, তপন রায়ের লোকগানও মানুষকে কাছে টেনেছে স্রেফ গায়কী আর মেঠোসুরের দৌলতে৷ পরের দিকে কালিকাপ্রসাদ শহুরে সমাজের সঙ্গে হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের মাটির গানকে জুড়েছেন৷ কালিকাপ্রসাদ এভাবে লোকগানকে মুখে মুখে ছড়িয়ে তাকে রক্ষা করতেও সফল হয়েছেন যথেষ্ট৷

একসময় স্বপন বসু জিনস পরে ব্যাঞ্জো হাতে লোকগান গাইছেন, এটা তরুণদের বেশি আকৃষ্ট করেছিল৷ সেই সংযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি৷ এই প্রজন্মের তরুণ সৌমেন্দু দাস নিজে লোকসংগীতের পাশে দোতারার মতো লোকবাদ্য চর্চা করেন৷ শহুরে আবহাওয়ায় গড়ে ওঠা ‘কনফিউশন' ফোক ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত সৌমেন্দু জানালেন, ‘‘নিঃসন্দেহে অনবরতভাবে বাঙালি শিল্পীরা বিশ্বের দরবারে লোকগানকে পৌঁছে দিচ্ছেন৷ তবে ফোকব্যান্ডে রিয়েলিটি শো বা সিনেমার কিছু জনপ্রিয় গানকেই বারবার পরিবেশিত করা হয়ে থাকে৷ এতে গানগুলির নিজস্বতা চলে যাচ্ছে৷ অন্যদিকে দোতারা, বাঁশি, ঢোল ইত্যাদি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে গ্রামবাংলার লোকগীতির দলগুলি বহু নতুন গান সংগ্রহ করে সুর তাল লয়ের ছোঁয়ায় সেগুলির রূপ দিচ্ছেন৷''

  তবে শুদ্ধতা যদি নষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে লোকসংগীত সংকটে পড়তে পারে৷ গবেষক শুভেন্দু মাইতির মতে, অনেকদিন আগেই সেই সংকটের পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘হাইব্রিড ফসল উৎপাদনের ফলে ৩৫০টি প্রজাতির ধান বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে৷ একইভাবে গানের বীজও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ এখন আর ধানের বীজ মাটিতে ফেললে গাছ হয় না৷ আলাদা করে চারাবীজ কিনতে হয়৷ গান লুপ্ত হলে কিনব কোথা থেকে?''

গত কয়েক দশকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে লোকগানকে বাঁচানোর জন্য তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ এ জন্য আক্ষেপ করে এই শিল্পী ও গবেষক বলেন, ‘‘বাম সরকারের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে হতাশাজনক৷ লোকশিল্পীদের জন্য কিছু করার তাগিদ থাকা উচিত ছিল কমিউনিস্ট পার্টির৷ কিন্তু তাঁরা এত বছর ধরে শিল্পীদের শুধু ভোটার ভেবেছেন৷''

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন লোকশিল্পীদের নাম নথিভুক্ত করে তাঁদের পরিচয়পত্র দিচ্ছে৷ তাঁদের জন্য মাসিক ভাতারও ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এতে কি কিছুটা সুরাহা হবে? শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘এতে শিল্পীদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চয়ই হয়েছে৷ কিন্তু তাতে লোকগানের কোনও উপকার হচ্ছে না৷ তাছাড়া সরকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে তাতে বিপদ বাড়বে৷''

লোকগানের অন্যতম জনপ্রিয় রূপ ‘গম্ভীরা' কতটা সংকটে পড়েছে, তা ডয়চে ভেলে জানতে চেয়েছিল গম্ভীরা শিল্পী অমর মণ্ডলের কাছে৷ মালদহের ইংরেজবাজারের একটি গম্ভীরা দলের প্রধান এই শিল্পী জানান, ‘‘এই গানের শিল্পীরা যথাযথ মর্যাদা পাননি৷ প্রত্যেকেই আলাদা পেশার সঙ্গে জড়িত৷ তার পাশাপাশি গম্ভীরায় অভিনয় করেন, কেউ গান করেন বা বাজনা বাজান৷'' তবে বিশিষ্ট এই লোকশিল্পী স্বীকার করেছেন, রাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় উপকার হয়েছে৷ এখন কলকাতার মঞ্চে অনেক বেশি গান গাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ যদিও অন্যান্য লোকগানের মতো গম্ভীরার আধুনিকীকরণ না হওয়ায়, তার মূল রূপটি অক্ষুন্ন রয়েছে৷ স্বস্তিতে রয়েছেন পালাকার ও মূল গায়েন অমর মণ্ডল৷ তবে সব লোকশিল্পীই এমন স্বস্তিতে নেই বলে জানালেন কবি জয়দেবের স্মৃতিজড়িত কেন্দুলির ‘মনের মানুষ বাউল ফকির কালচারাল সোসাইটি'র তন্ময় বাউল৷ বিশিষ্ট এই বাউল জানালেন, ‘‘লোকগীতি, লোকবাদ্য ও লোকনৃত্যের সমন্বিত রূপই লোকসংগীত৷ গীত, বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হয় বলে বাউল লোকসংগীতের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ তাই মানুষ চিরকালই সাধকদের বাউলগান পছন্দ করেন৷''

এ যুগের মানুষের কাছে বাউল গানের আবেদন কেমন? তন্ময় বাউল এ প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ‘‘বাউল গানের চর্চা নিঃসন্দেহে বেড়েছে৷ তাল-বাদ্য ও সুরের সবটাই যে সবাই বুঝতে পারেন, তা নয়৷ আবার বাউলগানের অন্তর্নিহিত অর্থও যে সবাই বুঝতে পারেন, এমনও না৷ কিন্তু কখনও সুর, তো কখনও গৌণ অর্থ ধরেই ৮০ শতাংশ মানুষ বাউলগানের শ্রোতা৷ ইদানীংকার শহুরে সংস্কৃতিতে যেভাবে বাউলগানকে পরিবেশিত করা হয়, তাতে বাউলগানের অপভ্রংশ হচ্ছে যেমন, পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও বাড়ছে৷''

লালন, রবীন্দ্রনাথের পরে পূর্ণদাস বাউল, পবনদাস বাউল নিঃসন্দেহে বাউলগানকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন৷ আবার বিশ্বের দরবারে রঙচঙে পোশাক পরে একতারা, দোতারা, খঞ্জনির মতো বাদ্য ছেড়ে গিটার ধরে অনেকে আবার বাউল গান গাইছেন৷ এসব নিয়ে ‘মনের মানুষ' আখড়ার তন্ময় বাউল জানালেন, ‘‘সাধনদেব বৈরাগী আমাদের গুরু৷ এটা আমরা মোটেও সমর্থন করি না৷ বাউলের মতো গভীর বোধের গানকে এভাবে পয়সার জন্য বেচতে আমরা পারব না৷ নিজেদের বোধ এবং সংস্কৃতি থেকেই আমরা বাউলগানের যেমন চর্চা করি, তেমনই করে যাব৷ আধুনিকতার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করব না৷''

‘নিঃসন্দেহে অনবরতভাবে বাঙালি শিল্পীরা বিশ্বের দরবারে লোকগানকে পৌঁছে দিচ্ছেন’

 একদিন মুখে মুখে প্রচলিত কথাতেই বাঁধা হয়েছিল বাংলার লোকগান৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাংলার গ্রামীণ জনতা তাঁদের বিভিন্ন লোকাচার ও উৎসবের সঙ্গে এই স্বয়ম্ভু সংগীতের ধারাকে জুড়ে রেখেছেন৷ এমনই কোনও মানুষের খোঁজে ডয়চে ভেলে পৌঁছে গিয়েছিল নদিয়ার কুর্শি গ্রামে৷ খুঁজে পাওয়া গেল সুশীল সর্দারকে৷ তথাকথিত সভ্য সমাজ তাঁকে শিল্পী না বলুক, আদতে গানই তাঁর জীবন৷ আদিবাসী সম্প্রদায়ের যে কোনও উৎসবে নৃত্য-গীতের আয়োজন থাকে, সেখানে সুশীলই মূল গায়েন৷ গান গাইতে গাইতে বিভোর হয়ে যান মধ্যবয়স্ক মানুষটি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গান আমাদের শিখতে হয় না৷ ছেলেবেলা থেকে শুনে শুনে গান শিখে যাই৷ আমাদের সব পরবেই তো গান থাকে৷'' সুশীলের মতো মানুষ, যাঁর ঠোঁটে হাজারও অজানা লিরিক ও সুর খেলা করে, যাঁকে কোনও ক্যাসেট কোম্পানি শিল্পীর মর্যাদা দেয়নি, তাঁর মতো মানুষ আজও সভ্যতার শিকড়ে লোকগান ও সংস্কৃতিকে পুষ্টি জোগান দেন৷

শুভেন্দু মাইতি এই সুশীলদেরই ‘শিকড়' বলে চিহ্নিত করেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সমাজ একটা বৃক্ষের মতো, যার মাটির উপরিভাগের অংশ হচ্ছে আমাদের নাগরিক সংস্কৃতি৷ মাটির উপরে যতটুকু অংশ থাকে, ততটাই অংশ থাকে মাটির তলায়৷ এই শিকড়ের অংশটুকুই আমাদের লোকসংস্কৃতি৷ সেটি দৃশ্যমান না হলেও গাছকে বাঁচিয়ে রাখে৷ এই শিকড় শুকিয়ে গেলে গাছের পাতা আর সজীব থাকবে না, হলুদ হয়ে যাবে৷ তাই শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব৷''

আবার সেই দায়িত্ব থেকেই শহরের বুকে নির্মলেন্দু চৌধুরীর ৯৫তম জন্মশতবর্ষে লোকশিল্পী অভিজিৎ আচার্য জানালেন, ‘‘শিল্পীর সমস্ত গান তেমনভাবে এতদিন সংগ্রহ করা হয়নি৷ এবার আরও ৫ বছর ধরে সেই গান সংগ্রহ করে শতবর্ষ পালন করতে চলেছি আমরা৷ একইসঙ্গে নির্মলেন্দু চৌধুরী ফোক অ্যাকাডেমি করার ভাবনাও আছে৷'' কাজেই বলতে পারা যায়, আধুনিকতার আগ্রাসনেও দিব্যি বেঁচে আছে লোকগানের পরম্পরা৷ শুধু গ্রামীণ মানুষের উৎসব ও জীবনচর্যায় নয়, লোকগান বেঁচে আছে লোকশিল্পীদেরও চিরায়ত জীবনচর্যায়৷

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য