দোতারায় জুড়ছে ভারত-বাংলাদেশ
২১ জুলাই ২০১৭এই আক্ষেপ ঘুচিয়ে হারিয়ে যাওয়া দোতারার সুর ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছেন কয়েকজন তরুণ৷ তাঁরা ফেসবুকে খুলেছেন একটি নতুন গ্রুপ ‘দোতারা বাজাই'৷ তবে এঁরা শুধু দোতারাই বাজান না, হারিয়ে যেতে বসা এই লোকবাদ্যযন্ত্র নিয়ে গবেষণাও করেন৷ সুর তৈরি করেন ও তা সীমান্তহীন বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দেন৷ তাই তো এই দোতারার দুই তারে দুই বাংলা এসে মিশেছে৷ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের আরো একটা সেতু গড়ে উঠেছে৷
লোকগানের সঙ্গে দোতারার যোগ অচ্ছেদ্য৷ তার দুই তারের ধ্বনিতেই মাটির গন্ধ লেগে৷ বাংলার লোকসংগীত বলতে যে বাদ্যযন্ত্রগুলির কথা মাথায় আসে, লোকসুরের উদাস-অচিন পরম্পরার সঙ্গে যা সবচেয়ে বেশি খাপ খেয়ে যায়, সে তো দোতারাই৷
অবশ্য নামে দোতারা হলেও তাতে যে দু'টো তারই থাকবে, এমনটা নয়৷ ক্ষেত্র বিশেষে তারের সংখ্যা বাড়লেও নামটি সেই একই থেকে যায়৷ কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে তার বাঁধা থাকে৷ টানটান তারে শিল্পীর আঙুলের পরশে জাগে মাটির সুর৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগীতচর্চার ধরনে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ বিশ্বায়নের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের ধারায় বানভাসি হয়েছে বাঙালির বসত৷ ভেসে গেছে তার অনেক নিজস্ব কৃষ্টি৷ নতুন প্রজন্মের সংগীত বিলাসে জ্যাজ, রকের প্রাধান্য অনেক বাদ্যযন্ত্রকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে৷ তবে সৌভাগ্যের বিষয়, এই পাশ্চাত্য ধাঁচের সংগীতচর্চা কেবল শহর ও শহরতলিতেই তার শিকড় ছড়িয়েছে, গ্রামীণ জীবনেও তার ছোঁয়াচ লেগেছে৷ কিন্তু তথাকথিত শহুরে ও শিক্ষিত সমাজের বাইরে দেশের এক বিপুল অংশের মানুষ আজও পরম্পরাগত বিনোদনে অভ্যস্ত৷ তাদের কাছে দোতারার মতো লোকবাদ্যের আবেদন কমেনি৷
পাশ্চাত্য সংগীতের চর্চা অতীতেও ছিল, বর্তমানে তার প্রসার বাঙালিকে নিশ্চয়ই বিশ্বনাগরিক করে তুলেছে৷ এর ফলে বাঙালির সুরসাধনা সমৃদ্ধ হয়েছে বৈকি৷ কিন্তু তাতে নিজের ধনসম্পদ হারিয়ে গেলে খেদ জাগতেই পারে৷ সেই খেদ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌমেন্দু দাস তৈরি করেছেন ‘দোতারা বাজাই' ফেসবুক গ্রুপ৷ এবং তাতেই একটু একটু করে চাকা ঘুরতে শুরু করেছে৷ শহুরে তরুণরাই মজছে দোতারায়৷ ফিরে যাচ্ছে শিকড়ের টানে৷
কেন এই গ্রুপ তৈরির কথা মনে হলো সৌমেন্দুর? তাঁর নিজের কথায়, ‘‘কারও যদি দোতারা শেখার ইচ্ছে হয়, তিনি সমস্যায় পড়বেন৷ কোথায় বাদ্যযন্ত্র মিলবে, কে শেখাবেন, এটাই জানা মুশকিল৷ আমাদের ফেসবুক গ্রুপ এই সমস্যার সমাধান করেছে৷ একই সঙ্গে সমমনোভাবাপন্ন মানুষদের একজোট করেছে, জুড়েছে ভারত-বাংলাদেশকে৷ দোতারা বাজাই গ্রুপের ৮০ শতাংশ সদস্যই তো বাংলাদেশের!''
ফেসবুকে ‘দোতারা বাজাই'-এর পেজে গেলেই আপনার মন ভরে যাবে৷ শুধু তরুণরাই নন, কত ধরনের মানুষ এই মঞ্চে দোতারার টানে সামিল হয়েছেন৷ নদিয়ার রানাঘাটের মিঠুন হালদার পাঁচ মাস আগে এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন৷ তিনি নিজে দোতারা তৈরি করেন, বিক্রি করেন৷ দোতারা কেনার জন্য মাথা খোঁড়ার দরকার নেই৷ যে কেউ এই গ্রুপে ঢুকলে মিঠুনের ফোন নম্বর পেয়ে যাবেন৷ কেন দোতারা শেখার পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র তৈরির ভাবনা৷ মিঠুনের ভাষায়, ‘‘আমার গুরু ভঞ্জন পোদ্দার এটাই শিখিয়েছেন৷ প্রকৃত শিল্পী হতে হলে নিজেকে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে বাজাতে হবে৷''
উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার কাছে সংহতিতে থাকেন ভঞ্জনবাবু৷ মাটির কাছাকাছি থাকা এই মানুষটির কাছ থেকে সুর নিয়ে সেটা আন্তর্জালে ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়েছেন মিঠুনরা৷ বাংলাদেশের বহু মানুষ সৌমেন্দুর ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ছবি বা মন্তব্য যখন মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে, সে সময় দাঁড়িয়ে তার এই অসামান্য প্রয়োগ, ধর্ম-সম্প্রদায়- জাতি-জাতিয়তা নির্বিশেষে সকলকে কাছে টানার চেষ্টা সাধুবাদযোগ্য৷ বাংলাদেশে দোতারা নিয়ে উদ্যোগ কতটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তার প্রমাণ ঢাকার এফএম প্রচারতরঙ্গে অনুষ্ঠান৷ সেখানে এই গ্রুপের এক সদস্যের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে৷
বাংলাদেশের যশোরের বিকাশ শীল ‘দোতারা বাজাই'-এর সঙ্গে যুক্ত৷ নিয়মিত ভারতে এসে অনুষ্ঠান করেন, দারুণ সাড়া পান৷ তিনি বলেন, ‘‘দোতারায় মানুষের আগ্রহ বাড়ছে৷ কত মানুষ যে এর সুর শুনে আপ্লুত হন, তা বলে বোঝানো যাবে না৷''
শুধু কি ভারত-বাংলাদেশ, দোতারার সুর মেঘে-মেঘে পৌঁছে গিয়েছে সাগরপারেও৷ সুদূর অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাঙালি তারিক আহমেদ সে দেশে বসে দোতারার চর্চা করছেন৷ কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় পাবেন বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার সুযোগ? তাই বাংলাদেশি তারিকের ভরসা স্কাইপ৷ সঙ্গে রয়েছেন সৌমেন্দু, মিঠুন, বিকাশরা৷ তারিক বলেন, ‘‘২০০৭-এ উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসি৷ তখন দোতারা শেখার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না৷ এখন সেই সুযোগ হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে৷ দুই বাংলার সঙ্গে বিদেশেও দোতারা সংস্কৃতির মিলনসেতু হয়ে উঠেছে৷''
‘দোতারা বাজাই' গ্রুপ বাংলাদেশে কর্মশালার আয়োজন করেছে৷ তাতে দারুণ সাড়াও মিলেছে৷ একুশ শতকের এই কাহিনি জানান দিচ্ছে, আধুনিক যোগাযোগের মঞ্চকে কাজে লাগিয়েই দোতারার পুনর্জন্ম হচ্ছে এ যুগে৷ ইঞ্জিনিয়রিংয়ের পড়ুয়া হোক বা তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন দোতারার প্রতি৷ একে সময়ের বিপরীতে হাঁটা বলে মনে করার কিছু নেই, আদতে শহরের কোলাহল ও ব্যস্ত জীবন থেকে যাঁদের ছুটি মেলে না, তাঁরা দোতারার সুরে অলীক ভ্রমণে বেরোতে চান৷ হাতের দোতারা বেজে উঠতেই আম-জাম- হিজল-বটের ছায়া নেমে আসে চারপাশে৷ ধানখেতের আল দিয়ে খালি পায়ে, কাদা মেখে হেঁটে যায় বিপন্ন শহুরে প্রাণ৷ জলে ভাসে তেচোখো মাছ, মন ভেসে যায় দূরে কোথাও, দূরে-দূরে!