প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কী ইঙ্গিত দেয়?
২৪ নভেম্বর ২০১৭বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সম্প্রতি কয়েকজন ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়া ও মানুষের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎ করে মানুষ গুম হচ্ছে, নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে৷ মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘গত ৫ বছরে নিখোঁজ হয়েছে ৫১৯ জন মানুষ৷ তাঁরা কিভাবে নিখোঁজ হলো? ক'দিন আগে অনিরুদ্ধ রায় ফিরে এলো৷ সে কোথায় ছিল? কে তাদের নিয়ে গেল? অন্যরা ফিরলো না৷ তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ঘরে বসে মানুষ খুন হচ্ছে৷ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে৷''
এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব, এটা অস্বীকার করছি না৷ বিরোধীদলীয় নেতা গুমের কথা বলেছেন, এই গুম তো বহুভাবেই হচ্ছে৷ অনেকে ফেরতও আসছে৷ কিন্তু ফেরত আসা বা খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে বড় করে খবর হয় না৷'' তিনি বলেন, ‘‘কী কারণে হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে৷ এটা কি শুধু বাংলাদেশে? ২০০৯ সালের একটি হিসাবে ব্রিটেনে ২ লাখ ৭৫ হাজার ব্রিটিশ নাগরিক গুম হয়ে গেল৷ তার মধ্যে ২০ হাজারের কোনো হদিসই পাওয়া গেল না৷ অ্যামেরিকার অবস্থা আরও ভয়াবহ৷ তাদের সব কিছু তো আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, তারপরও সেই দেশে এত লোক গুম হয়, তার খোঁজ পাওয়া যায় না৷ ৫৪ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বাস৷ এইটুকু ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে এত মানুষের অবস্থান৷ অথচ এই সকল উন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যা কত? সেই তুলনায় আমরা অবস্থা অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে রেখে যখন কোনো ঘটনা ঘটছে সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ নিচ্ছি৷''
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘আমাদের একজন স্বনামধন্য আঁতেল ‘গুম' হয়ে গেলেন৷ পরে দেখা গেল উনি গুম হননি৷ উনি নিজে নিজেই খুলনায় গেলেন৷ পরে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল৷ এর দোষটা আমাদের৷ এ ধরনের আরও অনেক ঘটনা তো ঘটে যাচ্ছে৷ আমি তার নামধাম বলতে চাই না৷''
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ফরহাদ মজহারের পর গত আড়াই মাসে ১০টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে৷ ফরহাদ মজহার অবশ্য নিখোঁজ হওয়ার ১৬ ঘন্টার মধ্যে খুলনা থেকে উদ্ধার হয়েছেন৷ তবে তিনি উদ্ধার হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি৷ শুধু পুলিশের কাছে এবং আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন৷
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন৷ তাদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৪৪ জন ব্যক্তির৷ নিখোঁজের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে বিভিন্নভাবে ফিরে আসেন ২৭ জন৷ তবে এখনও ১৭৭ জনের কী অবস্থা তা জানা যাচ্ছে না৷ তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা পরিবার বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ বলতে পারছেন না৷
আসক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এরমধ্যে অনেককেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয় হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকেও অপহরণের অভিযোগ আছে৷ আর প্রতিটি অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনার পরই পরিবারের পক্ষ থেকে সহায়তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিতে গেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কোনও উত্তর দিতে পারে না৷
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে বেআইনিভাবে গোপন স্থানে আটকে রেখেছে বলে কিছু দিন আগেই অভিযোগ তোলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও গুমের অভিযোগ করে আসছে৷
সম্প্রতি নিখোঁজ ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী ফিরে এলেও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার ও সাংবাদিক উৎপল দাশের সন্ধান এখনও মেলেনি৷
আসক-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকারকর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা সত্য যে উন্নত অনেক দেশেই গুমের ঘটনা ঘটে৷ কিন্তু তার সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য আছে৷ ওইসব দেশে ঘটনা ঘটার পর রাষ্ট্র অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসে৷ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বিচার ও ক্ষতিপুরণ পায়৷ কিন্তু বাংলাদেশে দৃশ্যত গুমের কোনো কার্যকর তদন্ত হয় না৷ সংসদে যদি বিষয়টি নিয়ে ধৈর্য্য সহকারে আলোচনা হতো, প্রস্তাব উত্থাপন হতো, সেটি বরং সাধারণ মানুষের জন্য, আমার জন্য অনেক উপকারে আসতো৷ যাঁরা গুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের পরিবার আশ্বস্ত হতে পারতো যে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এক ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ হয়তো তাঁরা তাঁদের নিখোঁজ স্বজনদের ব্যাপারে জানতে পারবেন৷ জীবিত না হলেও তাঁদের কবর কোথায় তা জানতে পারবেন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘অপহরণের পর যাঁরা ফিরে এসেছেন এবং অপহৃতদের স্বজনদের সঙ্গে আমরা কথা বলে জেনেছি, যারা গুম করে বা অপহরণ করে নিয়ে যায়, তারা স্মার্ট, দক্ষ, প্রশিক্ষিত এবং তাদের শারীরিক গঠন শক্তিশালী৷ আর অপহৃতদের এমন জায়গায় রাখা হয়, যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ৷''
নূর খান আরো বলেন, ‘‘রাষ্ট্র এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, যা প্রশ্ন তৈরি করে৷ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর এটা আশঙ্কা করা যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো একটি অংশ এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে৷ অথবা যারা করছে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী৷''
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অতীতে গুমকে সরাসরি অস্বীকার করা হতো৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে স্বীকার করেছেন যে, গুম হচ্ছে৷ সেটার ভয়াবহতা কোন মাত্রায় তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে৷ প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি এড়িয়ে যাননি৷ বরং কোথায় গলদ আছে তা চিহ্নিত করার কথা বলেছেন৷ তিনি আরো বলেছেন মাথায় পচন ধরেনি৷ তাই শরীরের অন্য কোনো অংশে যদি কোনো ক্ষতের সৃষ্টি হয় তা সারাতে তিনি ব্যবস্থা নেবেন এই আশা আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে করতে পারি৷''
ড. মিজান বলেন, ‘‘গুমের বিচার এখন আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই৷ জাতিসংঘে গৃহীত গুম বিষয়ক সনদে এটাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং মানবতাবিরোথী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে৷ তাই বিশ্বের যে কোনো দেশ অন্য কোনো গুমের ঘটনার বিচার করতে পারে৷ এ দেশে যদি বিচার না হয়, তাহলে এই বিচার বিশ্বের অন্যকোনো দেশেও হতে পারে৷ গুম একটি জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ৷ আর সেটা এখন আন্তর্জাতিকভাব স্বীকৃত৷''