অপহরণ-নিখোঁজ নিয়ে নানা প্রশ্ন
৯ নভেম্বর ২০১৭নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান সিজার মঙ্গলবার বিকাল থেকে নিখোঁজ৷ তাঁর বাবা মোতাহার হোসেন বাংলা বুধবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘দক্ষিণ বনশ্রীর বাসা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৭টায় আমার ছেলে বের হয়৷ বিকাল ৩টায় তার মোবাইলে ফোন দেই৷ তখন সিজার কল রিসিভ করেনি৷ ঘণ্টাখানেক পর বিকাল ৪টার দিকে সে ফোন করে বলে, জাতিসংঘের একটি বৈঠকে যাচ্ছে, রাতে ফিরবে৷ রাত ৯টা বেজে যাওয়ার পরও ছেলে বাসায় না ফিরলে ফোন দেই৷ কিন্তু তখন থেকেই তার মোবাইল বন্ধ পাই৷''
এরপর ছেলের নিখোঁজের বিষয়টি জানিয়ে খিলগাঁও থানায় একটি জিডি করেন তিনি৷ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সিজারের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তার সন্ধান পেতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি৷''
সিজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন৷ পরে যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন৷ দেশে ফিরে এসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন৷
তিনি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সম্পৃক্ততাও গবেষণার বিষয় ছিল তাঁর৷ এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন' প্রকল্পের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন৷ তাঁর এক বন্ধু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সিজারের এ সব কাজ ছিল পুরোপুরি গবেষণাধর্মী৷ এই গবেষণার মধ্যে জঙ্গি দমন বা এ জাতীয় কিছু ছিল না৷ তবে সে সম্প্রতি তার নিরপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল৷ আর এ কারণেই সম্প্রতি সে তার বাসায় ‘সিসি ক্যামেরা' লাগিয়েছিল৷''
যদিও মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘সিজার তাঁর নিরপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে থানায় কখনও কোনো তথ্য দিয়েছে বলে আমাদের জানা নাই৷''
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ফরহাদ মজহারের পর গত আড়াই মাসে ৯টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে৷ ফরহাদ মজহার অবশ্য নিখোঁজ হওয়ার ১৬ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার বাইরে খুলনা থেকে উদ্ধার হন৷ তবে তিনি উদ্ধার হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি৷ শুধু পুলিশ এবং আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন৷
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ এই সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন মোট ২৮৪ জন৷ এঁদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৪৪ জন ব্যক্তির৷ নিখোঁজের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে বিভিন্নভাবে ফিরে আসেন ২৭ জন৷ তবে এখনও ১৭৭ জনের কী অবস্থা তা জানা যাচ্ছে না৷ তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা পরিবার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ বলতে পারছেন না৷
আসক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে অনেককেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকেও অপহরণের অভিযোগ আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে৷ তাছাড়া প্রতিটি অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনার পর পরিবারের পক্ষ থেকে সহায়তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যাওয়া হলে, তারা তাঁদের কোনো উত্তর দিতে পারেনি৷
গত বছরের ১৬ মার্চ অপহৃত হন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা৷ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির যে ঘটনা ঘটেছিল, তার নানা দিক নিয়ে গণমাধ্যমে নিজ পরিচয়ে মতামত দেওয়ার পর তাঁকে মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়৷ সাতদিন পর অবশ্য এয়ারপোর্ট রোড এলাকায় পাওয়া যায় তাঁকে৷ গত ১৯ জুলাই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ সে সময় জোহা জানান, ‘‘আমাকে আটকের পর মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয়৷ এরপর আমাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে, তার কিছুই আমি বুঝতে পারিনি৷ আমাকে কতদিন আটক রাখা হয়েছিল, তাও আমি বুঝতে পারিনি৷ উদ্ধার হওয়ার পর পরিবারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তবে প্রথমেই যে আমাকে ইনজেকশন ‘পুশ' করা হয়েছিল, তা আমি বুঝতে পারি৷ যারা আমাকে মাইক্রোবাসে তুলেছিল তাদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনি৷ আমি শুরুতে তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি৷''
গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওনা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক ফিরে আসার পরও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি৷ পুলিশও এটা নিয়ে কোনো তদন্ত করেনি৷
লক্ষীপুরের চিকিৎসক মুহাম্মদ ইকবাল মাহমুদ গত ১৫ অক্টোবর রাতে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় থেকে অপহৃত হন৷ ঘটনার সাড়ে সাত মাস পর, এ বছরের ১ জুন চোখ বাঁধা অবস্থায় লক্ষিপুরে তাঁকে ফেলে যায় অপহরণকারীরা৷ ইকবালের বাবা নুরুল আলম জানান, ‘‘আমরা ছেলে কোনোকিছুই বলতে পারে না৷ ঘটনার পর আমরা দৌড়াদৌড়ি করেছি৷ সবার সহযোগীতায় তাকে ফিরে পেয়েছি৷ ইকবাল এখন মোটামুটি ভালো আছে, চলাফেরা করছে৷''
আসক-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান নিখোঁজ এবং অপহৃতদের নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যাঁরা নিখোঁজ বা অপহৃত হন, তাঁদের পরিবার এবং যাঁরা ফিরে আসেন, তাঁদের কাছ থেকে আমরা কিছু তথ্য পাই৷ অপহরণের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত এবং সুশৃঙ্খল ব্যক্তিরা অপহরণের সঙ্গে জড়িত৷ যাঁরা ফিরে আসেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, তাঁদের অত্যন্ত সুরক্ষিত জায়গায় রাখা হয়েছিল৷ যারা পহারায় থাকে তারাও নাকি সুশৃঙ্খল৷''
নূর খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এত ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা যে এখানে সাধারণ অপহরণকারীরা কাউকে অপহরণ করে বেশিদিন রাখতে পারে না৷'' তিনি জানান, ‘‘অপহরণ বা নিখোঁজের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তেমন কোনো তৎপরতাও দেখায় না৷ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগও নিতে চায় না৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে নূর খান বলেন, ‘‘নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মোবাশ্বার হাসান সিজারের নিখোঁজের ঘটনাটি নিয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করার সময় আসেনি৷ তবে তিনি জঙ্গি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন৷ নিজেও নিজের নিরপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন৷ এর থেকে ধারণা করা যায় যে, ঐ গবেষণা সংক্রান্ত বিষয় তাঁর নিখোঁজ হওয়ার পিছনে কাজ করে থাকতে পারে৷ কিন্তু এটা একটা ধারণা মাত্র৷ বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারে৷''
উপ-কশিনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা নানাভাবে তাঁকে উদ্ধারে কাজ করছি৷ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একাধিক ‘টিম' কাজ করছে৷ নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলোও খতিয়ে দেখছি আমরা৷''
নিঁখোজ বা অপহরণের পর পুলিশের কোনো তৎপরতা থাকে না – এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ মেনে নেয়া যায় না৷ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে আমরা তা দেখতে পারি৷''
এদিকে বৃহস্পতিবার সিজারের বাবা বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ তবে এ দিন দুপুরের পর তাঁরা সিজারের ব্যাপারে তথ্য জানতে এবং জানাতে গোয়েন্দা দপ্তরে যান বলে খবর৷
মোবাশ্বার হাসানের নিখোঁজের পিছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷