সবচেয়ে বেশি যৌতুকের বলি ভারতে
১ নভেম্বর ২০১৭এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বরপক্ষের দাবিমতো পণ না দিতে না পারার কারণে গোটা ভারতে প্রতিদিন গড়ে প্রাণ হারাতে হয় ২০ জন নববধূকে৷ রাজধানী দিল্লিতেই গত কয়েক বছরে পণপ্রথার কারণে প্রাণ হারান ৭১৫ জন নববধূ৷ এই সংখ্যা ক্রমশই উর্ধ্বমুখী৷ এ বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত পণ সংক্রান্ত কারণে ১০৫ জন নববধূর প্রাণ হারান৷ এই কুপ্রথা এক সামাজিক সংক্রমণের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখানে ধনী-দরিদ্র নেই, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা শহর-গ্রামের প্রশ্ন নেই৷ মানুষের অর্থলোলুপতাই একমাত্র কারণ বলে মনে করেন সমাজবিদরা৷ শুধু তাই নয়, পরিবারের সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে গয়না, নগদ অর্থ কিংবা বিলাসবহুল গাড়ি থেকে জমি, গরু, মহিষ কিছুই বাদ যায় না৷ না দিলে সমাজে বরপক্ষের মান থাকে না– এই ধরনের মানসিকতা এর পেছনে কাজ করে৷
জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু, মুসলিম সব সমাজেই পণপ্রথা পারিবারিক হিংসার এক বড় কারণ৷ পাকিস্তান বা বাংলাদেশেও তা বাড়ছে বলে সংবাদ মাধ্যমের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, যদিও মুসলিম ধর্মে পণপ্রথা নিষিদ্ধ৷
কয়েকদিন আগে দিল্লির ঘটনা৷ উচ্চ-শিক্ষিতা ২৮ বছরের এক নারী৷ দিল্লির আইআইটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে পিএইচডি-র ছাত্রী মঞ্জুলা দেবক ইনস্টিটিউটের হস্টেলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন৷ আত্মহত্যার আগে মঞ্জুলা তাঁর এক বান্ধবীকে হোয়াটস-অ্যাপে সবকিছু জানিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, তাঁর স্বামী নতুন ব্যবসা শুরু করার কারণ দেখিয়ে তাঁর বাপের বাডি থেকে ২৫ লাখ টাকা আনার জন্য চাপ দেয়৷ টাকা না পেলে ডিভোর্স করার হুমকি দেয়৷ মেয়ের আত্মহত্যার পর মঞ্জুলার বাবা মাথা চাপড়ে আর্তনাদ করেন, মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা খরচ না করে ঐ টাকা বিয়ের যৌতুকের জন্য রাখলে হয়ত মেয়ের প্রাণটা বাঁচতো! পুলিশ মঞ্জুলার স্বামী রীতেশকে ভোপাল থেকে গ্রেপ্তার করেছে৷
দিল্লির লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে পণের দাবিতে বৌয়ের গায়ে অ্যাসিড ঢেলে পুড়িয়ে মারে তাঁর স্বামী৷ পুলিশ তাঁর স্বামীকে অবশ্য গ্রেপ্তার করেছে৷ এই ধরনের পাশবিক ঘটনার অন্ত নেই৷ স্কুল শিক্ষিকা সংগীতা ভার্মাকে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে গত এপ্রিলে৷
এমন অসংখ্য ঘটনা৷ তার মধ্যে পুলিশ ৯৪ শতাংশের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেও দোষী সাব্যস্ত হয় ৩৫ শতাংশেরও কম৷ অবশিষ্ট মামলা বিভিন্ন আদালতে ঝুলে থাকে বছরের পর বছর৷ পুলিশের চার্জশিটে বধূ হত্যা কিংবা স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির অন্য লোকেরা দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে নববধূকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেবার উল্লেখ করা হয়৷ পুলিশ বিভাগের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হত্যা করা হয় জীবন্ত পুড়িয়ে৷ বধূর গায়ে কেরোসিন বা পেট্রোল কিংবা অ্যাসিড জাতীয় দাহ্য তরল ঢেলে৷ কারণ, পুড়িয়ে মারলে খুনের ঘটনা প্রমাণ করা শক্ত৷
জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর রেকর্ড অনুসারে, গত তিন বছরে পণপ্রথার কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার নববিবাহিত বধূকে৷ সবথেকে বেশি হয়েছে ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে– ৭০৪৮ জন৷ তারপর বিহার ও মধ্যপ্রদেশে, যথাক্রমে ৩৮২০ এবং ২২৫০ জন৷ স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের হাতে দৈহিক ও মানসিক পীড়নের অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো৷ সবথেকে বেশি পশ্চিমবঙ্গে– ৬১ হাজারেও বেশি৷ তারপর রাজস্থানে৷ সংসদে এই তথ্য জানান মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী৷
দেশের আইন এ ব্যাপারে কী বলছে ? ১৯৬১ সালের পণপ্রথা বিরোধী আইনে বিবাহে পণ দেওয়া বা নেওয়া নিষিদ্ধ হয়৷ কিন্তু তাতে ইতরবিশেষ কিছু হয়নি৷ সমাজে প্রচলিত বিবাহ ব্যবস্থায় আইনের ছাপ পড়েনি মোটেই৷ বিয়েতে রাজি হবার শর্তই হলো পণ দেওয়া বা নেওয়া, যেটাকে ভদ্র মোড়কে বা পোষাকি ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘উপহার'৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইনে অনেক ফাঁক রয়ে গেছে৷ সেগুলি দূর করে পণপ্রথা বিরোধী আইন আরও কঠোর করা দরকার৷ সেজন্য ১৯৮৩ সালে পণ বিরোধী আইন সংশোধন করা হয়৷ বাঞ্ছিত ফল তবু রয়ে গেছে অধরা৷ আসলে অপরাধীদের শাস্তিদানের আইনি প্রক্রিয়ার গোড়ায় গলদ৷ শুরুতে তদন্ত কাজে ঢিলেমি দেবার জন্য বিচার প্রক্রিয়ার গতি হয়ে পড়ে মন্থর৷ অবশ্য এর অন্য একটা দিকও আছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মেয়েপক্ষ কিংবা পুলিশ পণবিরোধী আইনের অপপ্রয়োগ করেছে৷ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়৷ গত অক্টোবর মাসে শীর্ষ আদালত পণ নেবার অভিযোগে চটজলদি কাউকে গ্রেপ্তার নিয়ন্ত্রিত করার সাময়িক নির্দেশ দেন৷ চূড়ান্ত রায় এখনও দেননি সুপ্রিম কোর্ট৷