‘সাংবাদিকদের নৈতিকতা কমছে’
১৯ মার্চ ২০২১ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ ধারণার পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছেন সবিস্তারে৷
ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর টিকা নেওয়ার অভিনয় করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এই ধরনের কাজ কতটা যৌক্তিক?
অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান: বিষয়টা যদি নৈতিক দিক থেকে বলা হয়, তাহলে যারা ভিডিও করতে গেছেন বা সাংবাদিকতা করতে গেছেন, তাদের দিক থেকে বিষয়টা দৈন্য৷ কারণ, তারা সঠিক সময়ে যেতে পারেননি, আবার মন্ত্রীকে বলেছেন মন্ত্রী আবার পোজ দিয়ে ভিডিও করার সুযোগ দিয়েছেন৷ জিনিসটা খুবই খেলো হয়ে গেছে৷ যারা নেতা-নেত্রী, তাদের যে ভাবমুর্তি বা স্থান সেটাও তারা স্মরণ রাখেন না৷ সেই কারণে সাংবাদিকরা যা বলেন, তারা তা-ই শুনতে বাধ্য হন, কিংবা সাংবাদিকদের খুশি করার জন্য পোজ দেন৷ এটা খুবই হাসির ব্যাপার হয়ে গেছে৷
মন্ত্রী দাবি করেছেন, একজন সাংবাদিকের অনুরোধ রাখতেই তিনি টিকা নেওয়ার অভিনয় করেছেন৷ কিন্তু এই ধরনের অনুরোধ করা বা রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত?
সাংবাদিকদের এই ধরনের আবদার করাটাই এক ধরনের খেলো বিষয়৷ এটা নৈতিক দিক থেকে সমর্থনযোগ্য না৷ তবে আমরা প্রায়ই দেখি, সাংবাদিকরা বা ফটোগ্রাফাররা বক্তা বা যারা উপস্থিত হন, তাদের ছবি তোলার জন্য কিছু ফরমায়েশ দিয়ে থাকেন৷ ফরমায়েশ এই অর্থে যে, তারা কিছু আবদার করে থাকেন৷ আপনি একটু দাঁড়ান বা পোজ দেন. এভাবে আমরা ছবিটা তুলি৷ এটা সুস্থ সাংবাদিকতার লক্ষণ বলে আমার মনে হয় না৷ ফ্যাশন ফটোগ্রাফি হলে একরকম৷ আমি যখন নিউজের জন্য কাজ করবো, তখন সাংবাদিকের নিউজ ভ্যালু বুঝতে হবে৷ সময়মতো যদি সে বিষয়টাকে গ্রহণ করতে না পারে সেটা তার ব্যর্থতা৷ এখানে সে আবদার করবে কেন?
আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, কোনো অনুষ্ঠান শুরু হলে ভিডিও ফটোগ্রাফাররা বক্তার সামনে ক্যামেরা নিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যান৷ এর ফলে অডিয়েন্স শুধু সাংবাদিকদের পশ্চাদ্দেশ দেখেন৷ তারা কিন্তু একটা কর্নার থেকে ছবি তুলতে পারেন৷ অথবা পেছন থেকে জুম করেও ভিডিও করতে পারেন৷ তা না করে খুবই অশোভনভাবে বক্তার সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যান৷ এতে অডিয়েন্স বিব্রত হয়৷ অনেক সময়ই দেখা যায় বক্তা দীর্ঘক্ষণ ধরে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং শ্রোতা যারা থাকেন তারা ক্যামেরাম্যানদের পশ্চাদ্দেশ দেখেন৷ এটা খুবই অশোভন৷ এটা সাংবাদিকতার নৈতিকতাবিরোধী একটি বিষয়৷ এটা ভদ্রতার অভাব৷
সাংবাদিকদের নৈতিক শিক্ষা কতটা প্রয়োজন? সেটা কি সাংবাদিকদের মধ্যে আপনি দেখতে পান?
আমাদের দেশে এখন প্রচুর সাংবাদিক হয়ে গেছে৷ এখন যে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা হয় তাই নয়, প্রচুর লোকজন আজকাল ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে যান, যেনতেন প্রেস কার্ড নিয়ে ঢুকে পড়েন৷ এতে করে আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিকতা, সেটা খুব লোপ পাচ্ছে৷ আবার সোশ্যাল মিডিয়ার নাম করেও কিছু লোকজন ভিড়ে যায়৷ এটাও একটা বড় সমস্যা৷ এই কারণে আমরা দেখছি, সাংবাদিকদের নৈতিক দিকগুলো খুবই হালকা হয়ে যাচ্ছে৷ এতে করে সাংবাদিকতার মান বা ভাবমূর্তি সবকিছুই ক্ষুন্ন হচ্ছে৷ নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য সাংবাদিকদের নিজেদেরই এদিকে তাকানো দরকার৷ এটাকে সুষ্ঠু-শোভনভাবে দাঁড় করানো তাদেরই দায়িত্ব৷
এসব ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল বা সাংবাদিক সংগঠনগুলো কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
আমার তো মনে হয় পারে৷ পেশার দিকে তাদের আরো একটু গুরুত্ব দেওয়া, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যে ভদ্রতা শেখানো, নৈতিক দিক থেকে এগুলো মেনে চলা- এগুলোর জন্য আমার মনে হয় প্রশিক্ষণ হওয়া দরকার৷ এগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার৷ না হলে সার্বিক সাংবাদিকতায় নৈতিক দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়বো বলেই আমার বিশ্বাস৷
আমরা যে ঘটনাগুলোর কথা বলছি, সেই ঘটনাগুলোতে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রচার পাওয়ার আগ্রহও তো থাকে...
দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমরা কাদের বলবো? এই ধরনের অনুষ্ঠান যারা আয়োজন করেন, তাদের বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকে৷ তারা মনে করেন, যদি সাংবাদিকরা বিরাগভাজন হন বা অসন্তুষ্ট হন তাহলে তাদের অনুষ্ঠানের খবর ভালোভাবে আসবে না, কাভারেজটা ভালো হবে না৷ এই কারণে তারা সাংবাদিকদের বেশি কিছু বলতে পারেন না৷ এটা তাদের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা৷ আরেকটা হলো, যেহেতু সাংবাদিকদের একটু তোষামোদ করে চলা হয় বা একটু সমীহ করা হয়, সেজন্য আমার ধারণা কিছু কিছু সাংবাদিক এই সুযোগটা বেশি করে নিয়ে ফেলেন৷ এটা বোধ হয় সুস্থ কোনো লক্ষণ না, শোভন কোনো বিষয় না৷
সাংবাদিকদের কাজ সত্য প্রকাশ করা, অথচ আমরা দেখছি, অনেকে কোনো অনুষ্ঠানে দেরিতে গিয়ে পরে একজনের বক্তব্য নিয়ে সেটা অনুষ্ঠানের বক্তব্য বলে প্রচার করছেন৷ হয়ত তিনি অনুষ্ঠানে সে কথা বলেননি৷ এই ধরনের প্রবণতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এখানে দু'টো বিষয়৷ একটা হচ্ছে, একটা অনুষ্ঠান হলে একজন বক্তা তিনি নেতা হন বা মন্ত্রী হন তিনি কী বললেন সেটিই হচ্ছে সংবাদ৷ সংবাদমূল্য বুঝে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে সাংবাদিককে৷ অনেক সময় আমরা দেখি, ওই বক্তার বক্তব্য শেষ হলে তাকে স্টেজ থেকে করিডোরে বা বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে আলাদা করে বাইট নেওয়া হয়৷ এটাও আরেকটা প্রবণতা৷ ওই বক্তা যে বিষয়ের উপর বক্তব্য দিয়েছেন সেটার উপর অতিরিক্ত কিছু জানার থাকলে সেটা করা যেতে পারে৷ তাতে কোনো অসুবিধা নেই৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, মূল অনুষ্ঠানটিকে বাদ দিয়ে একটা সাইড ট্র্যাক করে ওই মন্ত্রী কিংবা নেতার আলাদা একটা বক্তব্য নিয়ে নেন৷ এই জিনিসটাও খুব শোভন না৷ এটাও আমার কাছে খুব ভালো মনে হয় না৷ কারণ, বক্তা তো যা বলার অনুষ্ঠানেই বলেছেন৷ এমন যদি হয়, সেখানে বক্তব্যটি পরিস্কার হয়নি বা এর বাইরেও অতিরিক্ত কিছু জানার আছে, তাহলে হয়ত আলাদা করে বাইট নেওয়া যেতে পারে৷
সরকারিভাবে কি কোনো নির্দেশনা দিয়ে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব?
আমার মনে হয়, এই ধরনের কার্যক্রমে সরকারি নির্দেশনা কাম্য না৷ সরকার করবেই বা কেন? সব ক্ষেত্রে সরকারি অনুষ্ঠানে এমন হচ্ছে, তা কিন্তু না৷ বেসরকারি, কর্পোরেট, সামাজিক বা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক অনুষ্ঠানেও তো এমন হচ্ছে৷ ফলে কেন সরকারিভাবে এটা বলা হবে বা নিয়ন্ত্রণ করা হবে?
এক্ষেত্রে পত্রিকা অফিস বা টিভি চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান তার প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই এটা পালন করবে৷ তারা এই নৈতিক দিকের নীতিমালা মেনে চলবেন৷ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটা হতে হবে৷ সব ধরনের গণমাধ্যমের কর্মীদের নিজস্ব স্কিল ডেভেলপ করে বিষয়টাকে সমাধান করতে হবে৷
জনসংযোগ ও প্রোপাগান্ডার মধ্যে পার্থক্য কী?
জনসংযোগ হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য ইন্টার্নাল কর্মী এবং এক্সর্টার্নাল যে লোকজন থাকে, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে কর্মকাণ্ড করে, তাদের জন্য কাজ করবে৷ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক লোকজনের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরবে, যাতে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষা পায় বা আরো উজ্বল হয়৷ কিংবা কোনো সংকট থাকলেও জনসংযোগ কর্মকর্তারা সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেন৷ আর প্রোপাগান্ডা হচ্ছে কোনো ঘটনা সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, সেটাকে প্রভাবিত করার জন্য তারা কাজ করে থাকেন৷ প্রোপাগান্ডার একটা উদ্দেশ্য থাকে৷ সেখানে সত্য-মিথ্যার বিচার বিশ্লেষণ হয় না৷ জনসংযোগ কর্মকর্তাদের প্রোপাগান্ডা করার প্রয়োজন নেই৷