সাক্ষরতায় ত্রিপুরা
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৩সাক্ষরতা তো সাক্ষরতাই৷ সেটা যে কোনো ভাষার জন্যেই সাক্ষরতা৷ তা হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা দেশের মধ্যে সবথেকে স্বাক্ষর রাজ্য হয়ে উঠলে বাংলা ভাষার উল্লসিত হয়ে ওঠার কারণ কী?
অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন৷ কিন্তু তার জবাব খোঁজার আগে একবার ভারতে সাক্ষরতার হারের তথ্য-পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক৷ এতদিন পর্যন্ত ভারতের সবথেকে স্বাক্ষর রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে দক্ষিণ ভারতের কেরালা৷ এই নিয়ে কেরলবাসীর মনে নিশ্চিত গর্ব ছিল৷ ত্রিপুরা সেখানে ছিল সাক্ষরতা তালিকার অনেকটাই নীচে৷ ২০০১ সালে ৭৩.১৯ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে ত্রিপুরার স্থান ছিল ১৪ নম্বরে৷
এক দশক পর, সারা ভারতেই সাক্ষরতার হার বাড়ল প্রায় ৯ শতাংশ৷ ২০১১ সালের সাক্ষরতা জরিপে দেখা গেল, তখনও কেরল ৯৩.৯১ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে এক নম্বরেই রয়েছে৷ কিন্তু ৮৭.৭৫ শতাংশ সাক্ষরতা নিয়ে ত্রিপুরা তিন নম্বরে উঠে এসেছে৷ তার পর থেকেই ১০০ শতাংশ সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিল ত্রিপুরা৷ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের নেতৃত্বে তৈরি করা হল স্টেট লিটারেসি মিশন অথরিটি৷ সঙ্গে নেওয়া হল গ্রাম পঞ্চায়েত, পাড়ার ক্লাব এবং এনজিও-দের৷ রাজ্য জুড়ে তৈরি হল আট হাজারেরও বেশি প্রাথমিক সাক্ষরতা কেন্দ্র৷
২০১৩ সালের যে সাক্ষরতা সমীক্ষা করেছে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, তাতে দেখা যাচ্ছে ৯৪.৬৫ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে প্রথম স্থানে চলে এসেছে ত্রিপুরা৷ ৯৩,৯১ শতাংশ সাক্ষরতা নিয়ে দ্বিতীয় কেরল এবং ৯১.৫৮ শতাংশ সাক্ষরতার হার তৃতীয় স্থানে রেখেছে উত্তর-পূর্ব ভারতেরই আর এক রাজ্য মিজোরামকে৷
এখানে আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়৷ উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্য, চিরকাল যারা বাকি ভারতের কাছে অবহেলিত বলে তাদের এক ধরনের অভিমান এবং ক্ষোভ রয়েছে, তারা প্রায় প্রত্যেকে কিন্তু সাক্ষরতায় দেশের বাকি অংশ থেকে এগিয়ে৷ ত্রিপুরা এবং মিজোরাম ছাড়াও সাক্ষরতা তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে রয়েছে নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মণিপুর, অসম এবং অরুণাচল প্রদেশ৷ অবশ্য ২০১৩ সালের তালিকায় তিন নম্বরে উঠে এসেছে লাক্ষাদ্বীপ৷
তবে শতাংশের হিসেবে সাক্ষরতার হার নির্ণয়ের এই পদ্ধতি যে কিছুটা বিভ্রান্তিকর, সেটা বলাই বাহুল্য৷ লাক্ষাদ্বীপে মোট জনসংখ্যাই এত কম যে শতাংশের হিসেবে অন্য রাজ্যের তুলনায় সাক্ষরতার হার অনেক বেশি দেখাতে পারে৷ কিন্তু সেটা সমস্ত পরিসংখ্যানেরই সমস্যা৷ ত্রিপুরার ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য৷ ঐতিহাসিকভাবে ত্রিপুরা শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে থাকা রাজ্য হয়েও তার ভৌগোলিক অবস্থান তাকে কার্যত দলছুট করে রেখেছে৷ বাংলা ভাষার চর্চা ত্রিপুরায় যত ব্যাপক এবং গভীর, ততটা হয়ত পশ্চিমবঙ্গেও আর নয়, কিন্তু তাও পূর্ব ভারতে ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতির কথা হয় কলকাতার মুখের দিকে তাকিয়ে৷
সেই পরিস্থিতিতে প্রায় একশো শতাংশ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যে ত্রিপুরার এই প্রয়াস এবং এই সাফল্য নিঃসন্দেহে উদযাপন করার মতো ঘটনা৷ এবং বাংলা ভাষা, ভারতে অন্যান্য ভাষার দাপটে যা বস্তুত কোণঠাসা হয়ে আছে, সেই ভাষার চর্চা হয়, এমন একটা রাজ্য সাক্ষরতায় এক নম্বর হল, এটা বাঙালিদের পক্ষেই অত্যন্ত সুখবর৷ যে আনন্দটা পাওয়া যায় বাংলাদেশে সব পর্যায়ে বাংলাভাষার ইজ্জত এবং কদরে৷ কারণ পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষরতার নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে, যদিও সেটা পুরো দেশের সাক্ষরতার হারের সমান৷ কিন্তু সেটা আদৌ কোনও সান্ত্বনা পাওয়ার মতো বিষয় নয়৷ তা ছাড়া এই রাজ্যে এখন এত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুযের বাস যে পশ্চিমবঙ্গকে আর বাঙালি রাজ্য বলা বোধহয় ঠিক নয়৷ সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মশাল এখন ত্রিপুরারই হাতে৷
ত্রিপুরার জন্যে বিষয়টা আরও আনন্দের কারণ রাজ্যের যে জেলায় সবথেকে বেশি মানুষ স্বাক্ষর হয়েছেন বলে স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের গণনায় জানা গিয়েছে, সেটা উপজাতি অধ্যুষিত ধলাই৷ সেখানে ৯৭ শতাংশ মানুষ এখন সাক্ষর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের এখন একটাই আফসোস৷ তাঁর রাজ্যে নিরক্ষর লোকের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৬৩৪ জন৷ এঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে সাক্ষরতা কর্মসূচিতে আনা সম্ভব হয়নি৷ না হলে ত্রিপুরা হতো দেশের একমাত্র সম্পূর্ণ স্বাক্ষর রাজ্য৷