সাধারণ ক্ষমায় অর্থপাচার বাড়বে, উৎসাহিত হবে ঘুস-দুর্নীতি
৭ জুন ২০২২দেশ থেকে টাকা পাচার হয় এই কথা অর্থমন্ত্রী আ ন হ মোস্তফা কামাল আগে স্বীকারই করতেন না। কিন্তুসেই পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে এবার বাজেটে সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা। আর এই টাকা ফেরত আনতে সাত থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই সুযোগ থকবে। সুযোগ যারা নেবেন তারা ফৌজদারি ব্যবস্থা থেকে রেহাই পাবেন। অন্যদিকে দেশে কালো টাকা সাদা করারর সুযোগ এখনো আছে। আসন্ন বাজেটে সেটা কতটা থাকবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ তারই আরো বিস্তৃত প্রক্রিয়া। এটা করা হলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। দেশ থেকে অর্থপাচার আরো বাড়বে। বাড়বে অর্থ আয়ে অবৈধ প্রবণতা। উৎসাহিত হবে অনৈতিক অর্থব্যবস্থা। আর এতে কতটা ফল আসবে তা নিয়েও তারা সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। কারণ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সামান্য অর্থই অর্থনীতির মূল ধারায় ফেরত আনা গেছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্বিবিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন,"এটা কালো টাকা সাদা করার সুযোগের আরো বিস্তৃত প্রক্রিয়া। এর ফলে রেমিটেন্স কিছুটা বাড়লেও এটা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। দুর্নীতবাজদের বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেবে। এর ফলে ঘুস-দুর্নীতি আরো বাড়বে। যারা সৎভাবে আয় উপার্জন করছে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করবে। দুর্নীতিবাজদের সরকার এভাবে সমর্থন দিতে পারে না।”
তার কথা," এটা হলে দুর্নীতিবাজরা পাচার বাড়িয়ে দিয়ে সেই টাকা আবার কিছুটা দেশে এনে বৈধতা নেবে।”
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের( পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন,"এখন যদি পি কে সাহা তার সব পাচার করা টাকা দেশে নিয়ে আসে তাহলে কি আমরা তাকে মাফ করে দেব? মাফ করে দেয়া কি উচিত হবে? তাহলে তো দেশে আইন কানুন বলে কিছু থাকবে না। কালো টাকার মালিকেরা দেশের বাইরে আরো বেশি টাকা পাচার করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইন থেকে রেহাই পাবে। ফলে পাচার আরো বাড়বে। সরকার যা বলছে তা কোনো কাজের কথা না। আসল কাজ হলে দুর্নীতি বন্ধ করা, পাচার বন্ধ করা। আর এই ধরনের সুযোগ দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ সম্পদ ফেরত আনা গেছে বলে কোনো উদাহরণ আমার কাছে নাই।”
দেশের বাইরে কত টাকা পাচার হয়েছে, যারা পাচার করেছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে আছে কী না, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। আর প্রধানত দুর্নীতি যারা করেন তারাই টাকা পাচার করেন। তাহলে এই সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের অবৈধ অর্থ হালাল করার পাশাপাশি তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়া হবে। এর ফলে দুর্নীতি ও টাকা পাচার আরো উৎসাহিত হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলেন কালো টাকা সাদা করার তো সুযোগ আছে। তাতে কতটুকু ফল আসছে?
ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং-এর( সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন," এতদিন তো শুনে আসছি টাকা পাচার হয় না। তাহলে এখন টাকা পাচারের কথা কীভাবে আসে। তাদের সুযোগ দিয়ে সম্মনিত করা কেন? যেহেতু এখন টাকা পাচার হয় এটা স্বীকার করা হলো তাহলে এখন কাজ হচ্ছে কত টাকা পাচার হয়েছে, কোন কোন দেশে পাচার হয়েছে, কারা পাচার করেছে তা চিহ্নিত করা। আইনগত ব্যবস্থা নেয়া এবং পাচার বন্ধে উদ্যোগ নেয়া। সেটা না করে সাধারণ ক্ষমা দিয়ে দেশে টাকা আনার চেষ্টা তেমন কাজে দেবে না। আমরা দেখেছি কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ এখন আছে তাতেও তেমন ফল নাই। আর পাচার করা টাকা সরকার যেভাবে চাইছে সেভাবে ফেরত আনার কোনো সাকসেস স্টোরি আমার জানা নেই।”
তার কথা,"টাকা পাচার হওয়ার মূল কারণের মধ্যে আছে দুর্নীতি, ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া। এগুলো বন্ধ করতে হবে। কর ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। তাহলে দেশের টাকা দেশেই থেকে যাবে।”
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে সেখানে বাংলাদেশিদের টাকা জমা আছে প্রায় পাঁচ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমানের একটি হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। তারা বলছে বাংলাদেশে এখন কালো টাকার পরিমাণ ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। তাদের হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার থেকে মোট আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন," আমি বহুবার বলেছি এটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়। এতে ঘুস-দুর্নীতি উৎসাহিত হয়। টাকা পাচার আরো বেড়ে যাবে। আর বৈধ আয় যারা করেন তাদের শতকরা ২৫ ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হয়। কিন্তু অবৈধ আয় যারা করেন তারা সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বৈধ হয়ে যান, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাতেই সামান্যই ফল আসে।”
তার কথা, কর ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি। তাহলে অর্থনীতি লাভবান হবে। ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, কর ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশে অনুসরণ করতে হবে। তাহলে টাকা পাচার অনেক কমে যাবে।