সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াচ্ছে ফেসবুকে
১১ জুন ২০১৫নানা ধরণের ছবি সম্পাদনা ও ফটোশপ-এ কারসাজি করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলামানদের ওপর বৌদ্ধদের হামলা ও নির্যাতনের চিত্র বলে তা প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে৷ এছাড়া তার সঙ্গে তারা জুড়ে দিচ্ছে নানা কাল্পনিক তথ্য৷ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও এ সব ভুয়া ছবি ও তথ্যের উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে৷
যেসব ভুয়া ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে একটি ২০০৪ সালে থাইল্যান্ডে বিক্ষোভকারীদের দমন করার ছবি৷ ২০১০ সালে চীনে ভূমিকম্পের পর তিব্বতের বৌদ্ধদের উদ্ধার করা মৃতদেহ, ২০১০ সালে কঙ্গোতে গ্যাস ট্যাংকার বিস্ফোরণে দগ্ধ মানুষ, ২০১২ সালে দিল্লির একটি সড়কে এক তিব্বতি যুবকের নিজ শরীরে আগুন লাগিয়ে দৌঁড়ানোর ছবি, খেলনা বন্দুক নিয়ে খেলারত এক বার্মিজ শিশুর আলোকচিত্র, চীনের সাংহাই প্রদেশে ভূমিকম্পে নিহতদের লাশের ছবিও রোহিঙ্গা নির্যাতেনের ছবি বলে প্রচার করা হচ্ছে৷ এমনকি শ্রীলঙ্কায় এক ধর্ষিত নারীর দেহের ছবিকেও রোহিঙ্গা নারীর দেহ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে৷
সম্প্রতি সাগরে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের উদ্ধারের বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতার পর, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই অপপ্রচার শুরু হয়েছে৷ একটি গোষ্ঠী এগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে ফেসবুকে ‘পোস্ট' দেয়ার পর অনেকেই না বুঝে তা শেয়ার এবং নানা মন্তব্য করছেন৷ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা৷
তবে এর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই আবার প্রতিবাদ হচ্ছে৷ যেসব ছবি কারসাজি করে রোহিঙ্গাদের বলে চালানো হচ্ছে, তার মূল ছবি এবং আসল ঘটনাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ৷ এ সব ছবি দেখে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা৷
একজন ব্লগে লিখেছেন, ‘‘ফেসবুক, ব্লগে দীর্ঘদিন যাবৎ কিছু লোক তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ফটোশপ বা ক্রপ করে ছবি পোস্ট দিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে৷ আমাদের মধ্যে অনেকেই তাদের ফাঁদে পা দিয়ে এই সব ভুয়া ছবি নিয়ে আলোচনা করি, ফেসবুকে শেয়ার করি, উত্তেজিত হই৷ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা নির্যাতিত তা সারা বিশ্ব জানে, অনেকেই প্রতিবাদে সোচ্চার আছেন৷ তবে তাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই৷ এই সুযোগে অনেকেই মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ফটোশপ করা ভুয়া ছবি দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে৷ অনেকক্ষেত্রে তারা সফল ও হচ্ছে৷ এমনই কিছু ছবি শেয়ার করা হলো, যাতে ভুয়া তথ্যযুক্ত ছবির পাশে আসল তথ্য সমৃদ্ধ ছবি দেয়া হয়েছে৷''
এ নিয়ে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাংবাদিক বাধন অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা স্পষ্ট যে একটি মহল পরিকল্পিতভাকে এ সব ভুয়া ছবি এবং তথ্য ছড়াচ্ছে৷ তাদের ‘টার্গেট' সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়৷ এ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে৷ তবে সরকারের উচিত এ সব অপপ্রচার নিয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করা৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপপ্রচারের জবাব দেয়ার জন্য সরকারেরও উচিত এই মাধ্যম ব্যবহার করা৷''
তিনি বলেন, ‘‘এর আগে একই ধরণের অপপ্রচার হয়েছে৷ তবে এ ধরণের অপপ্রচার রোধ করা না গেলে যে কোনো সময় বড় ধরণের অঘটন ঘটে যেতে পারে৷''
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারকারী খোরশেদ আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই অপপ্রচারের মাত্রা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, এটা পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে৷ তবে আগের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারকারীরা সচেতন হয়েছেন৷ তাঁরা যে কোনো তথ্য এখন যাচাই করে দেখতে চান৷ কারণ তাঁরা জানেন যে, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সব ছবি বা তথ্য সঠিক নয়৷'' তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এই সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমেরও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন৷''
এই অপপ্রচারের কারণে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় বসবাসকারীরা আতঙ্কে আছেন৷ চট্টগ্রামের সাংবাদিক হামিদ উল্লাহ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘একটি মহল সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে৷ তারা এ ধরণের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়৷ অবশ্য এবার আগে থেকেই পুলিশ প্রশাসনসহ সুশীল সমাজ সতর্ক অবস্থানে আছে৷''
২০১২ সালে মিয়ানমারে জাতিগত সংঘর্ষের পর কক্সবাজারের স্থানীয় মুসলমানদের একাংশ পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধদের ওপর হামলা করে৷ এ হামলায় অংশগ্রণকারীদের অধিকাংশই ছিল রোহিঙ্গা মুসলমান৷ ফেসবুকে এক বৌদ্ধ যুবক ইসলামকে অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে এ হামলা করা হয় তখন৷
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার কুশুম দেওয়ান জানান, ‘‘সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভুয়া ছবির বিষয়টি আমাদেরও চোখে পড়েছে৷ আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম একটি উসকানিমূলক প্রচারণাকারীর নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিষয় গুরুতর হওয়ার ফলে কোনো অভিযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করছি৷''
তিনি জানান, ‘‘আমরা সংখ্যালঘু বিশেষ করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন এবং সতর্ক আছি৷ কোনো গোষ্ঠী যাতে এই অপপ্রচারের সুযোগ নিতে না পারে, আমরা সে ব্যাপারে কাজ করছি৷''