সিনহার বিরুদ্ধে হুদার মামলা, তৎপর দুদকও
১ অক্টোবর ২০১৮বর্তমানে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বিএনপি সরকার আমলের মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এই মামলা করেছেন৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা আমাকে তার খাসকামরায় ডেকে মোট সোয়া তিন কোটি টাকা ঘুস চান৷ তবে আমি তাকে ওই ঘুসের টাকা দেইনি৷ কয়েকটি মামলা থেকে রেহাই এবং ব্যাংক থেকে টাকা অবমুক্ত করে দেওয়ার আদেশ দেওয়ার বিনিময়ে তিনি ওই টাকা দাবি করেছিলেন৷''
নাজমুল হুদা বলেন, ‘‘সিনহা ঘুস আদায়ের জন্য আমার বিরুদ্ধে খারিজ হওয়া একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করেন৷ আর সেই মামলাসহ আরো একটি মামলা থেকে রেহাই দিতে দুই কোটি টাকা আর ব্যাংকে আটকে যাওয়া টাকা অবমুক্ত করে দেওয়ার জন্য সেই টাকার অর্ধেক দাবি করেন৷ তাতে আসে সোয়া কোটি টাকা৷ আমি তাকে কোনো টাকা দেই নাই৷ এটা ছিল ঘুস নেয়ার প্রচেষ্টা৷''
শাহবাগ থানায় গত বৃহস্পতিবার মামলাটি দায়ের করেছেন বলে জানান তিনি৷ তবে তাঁর এই মামলা সম্পর্কে সোমবার জানাজানি হয়৷ দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত ও আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় মামলাটি দুদকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ওসি আবুল হাসান জানিয়েছেন৷
এদিকে সোমবার সকালেই দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহার ভাই অনন্ত কুমার সিনহার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার একটি অভিযোগের অনুসন্ধান করছেন তাঁরা৷
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে গত বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তোপের মুখে পড়েন বিচারপতি সিনহা৷ এক পর্যায়ে তাঁর প্রকাশ্য বিচরণ বন্ধ হয়ে যায়, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অসুস্থ বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়েছেন৷ অক্টোবরে ঢাকার মিন্টো রোডের বাসা থেকে দেশ ছাড়ার সময় সিনহা বলে যান, তিনি অসুস্থ নন, আবার ফিরে আসবেন৷
এরপর কয়েক মাস অন্তরালে থাকা সিনহা আবার আলোচনায় আসেন এই মাসেই ‘আ ব্রোকেন ড্রিম' নামে তাঁর একটি বই প্রকাশের পর৷ সেখানে দেশত্যাগ ও পদত্যাগের জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন সিনহা৷ ডিজিআইএফের হুমকি পাওয়ার কথা বলেছেন তিনি৷
বইটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনার মধ্যে আবারও তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা৷
এর মধ্যে একটি টেলিভশনে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে তাঁর ভাইয়ের নামে দুই কোটির বেশি টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কেনার খবর প্রকাশ করা হয়৷
বর্তমানে নিউ জার্সিতে অবস্থানরত বিচারপতি সিনহাকে ওই টেলিভিশনের পক্ষ থেকে বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব দেননি৷
এই প্রেক্ষাপটে সকালে অনন্ত কুমার সিনহার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তে নামার কথা জানায় দুদক৷
বাংলাদেশর দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, অনন্ত কুমার সিনহার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷
অভিযোগ তিনটি হল: তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে দুই লাখ ৮০ হাজার ডলার দিয়ে একটি বাড়ি করেছেন, অবৈধভাবে অর্থপাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন৷
এই অভিযোগ তদন্তে দুদকের সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি৷
এক প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘অনন্ত কুমার সিনহা কার ভাই তা আমরা জানি নাG আর তিনি কোথায় অবস্থান করছেন, দেশে না বিদেশে তা-ও নিশ্চিত নই৷ তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে৷''
এস কে সিনহার বিরুদ্ধে কেনো তদন্ত শুরু হবে কিনা জানতে চাইলে প্রণব বলেন, ‘‘তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের কোনো নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি৷''
তাঁর এই কথার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিনহার বিরুদ্ধে নাজমুল হুদার মামলাটি দুদকে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন শাহবাগ থানার ওসি৷
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাজমুল হুদা এক সময় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন; খালেদা জিয়ার সরকারে যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন তিনি৷
কয়েক বছর আগে বিএনপি ছেড়ে প্রথমে বিএনএফ এবং তা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তৃণমূল বিএনপি নামে দল গঠন করেন হুদা৷
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএ) নামে একটি জোট গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে যোগ দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীও হতে চান তিনি৷
সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘খবরের অন্তরালে'র জন্য মীর জাহের হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে এক মামলায় নাজমুল হুদার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল৷ জরুরি অবস্থার সময় দেওয়া ওই মামলার রায়ে হুদার স্ত্রী সিগমা হুদারও তিন বছর কারাদণ্ড হয়৷
ওই রায়ের বিরুদ্ধে নাজমুল হুদা ও সিগমা হুদা আপিল করলে ২০১১ সালের ২০ মার্চ হাই কোর্ট তাঁদের খালাস দেয়৷ কিন্তু দুদকের আপিলে আপিল বিভাগ ওই রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির নির্দেশ দেয়৷ তখন আপিল বিভাগে ছিলেন বিচারপতি সিনহা৷ মামলার পুনঃশুনানি শেষে গত বছরের ৮ নভেম্বর হাই কোর্টের আরেকটি বেঞ্চ নাজমুল হুদাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয়৷
নাজমুল হুদা বলছেন, ‘বেঞ্চকে প্রভাবিত করে' তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা তাঁর বিরুদ্ধে আদেশ দিয়েছিলেন৷
তখন কেন মামলা করেননি জানতে চাইলে নাজমুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটি পত্রিকা সম্প্রতি এ নিয়ে রিপোর্ট করেছে, যা আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য৷ তাই আমি এখন মামলা করেছি৷''
সিনহার অ্যাকাউন্টে ‘চার কোটি টাকার' তদন্ত
এর আগে এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চার কোটি টাকা জমা দেওয়ার অভিযোগে দুই ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক৷
নিরঞ্জন ও শাহজাহান নামে দুই ব্যবসায়ী ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এই টাকা সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা করেছিলেন বলে অভিযোগ৷ এদিকে ঋণ অনিয়মে ধুঁকছে কয়েক বছর আগে কার্যক্রম শুরু করা এই বেসরকারি ব্যাংকটি৷
এই ঘটনায় গত সপ্তাহে ফারমার্স ব্যাংকের ছয় কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক কর্মকর্তারা৷ তারা হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এম শামীম, নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা সুলতানা, সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট শফিউদ্দিন আসকারী আহমেদ, সাবেক ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক হেড অব বিজনেস ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট গাজী সালাউদ্দিন ও ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়৷
রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা
বিচারপতি এস কে সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন৷
গত শনিবার ওয়াশিংটন প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এদেশে আমার কোনো স্ট্যাটাস নেই৷ আমি একজন শরণার্থী৷ আমি এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছি, কিন্তু এখনো এর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷''
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্স, জেনেভা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আশ্রয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ার কারণে তিনি সেখানে যেতে পারছেন না৷
নিজের অবস্থা ব্যক্ত করে এস কে সিনহা বলেন, ‘‘আমি এত ভীত থাকি যে, আমি ২৪ ঘণ্টা বাসায় থাকি৷ ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাসা সব সময় মনিটর করে এবং যারা আমার বাসায় যায়, তাদের ছবি তোলে৷''
পেশাগত কাজে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলা ট্রিবিউন-এর বিশেষ প্রতিনিধি শেখ শাহরিয়ার জামান ছিলেন ওই সংবাদ সম্মেলনে৷ তিনি টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এসকে সিনহা তাঁর প্রথম স্টেটমেন্টে বলেন, আ অ্যাম আ রিফিউজি৷ আমার এখানে কোনো স্ট্যাটাস নেই৷ এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি বলছেন আপনি রিফিউজি, তাহলে আপনি এখানে কী করতে চাচ্ছেন? জবাবে তিনি বলেন, আমি এখানে অ্যাসাইলাম চেয়েছি৷ তবে এখানো কোনো ডিসিশন পাইনি৷''
পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগাম কোনো তথ্য প্রকাশ করে না৷ দেওয়া হলেই তবে জানা যায়৷''
এসকে সিনহা ওই দিন নিউ জার্সিতে তাঁর ভাইয়ের বাড়ি সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে কিছু বলেননি৷ তবে তিনি জানান, প্রথম দুই মাস তিনি ওই বাড়ির বেসমেন্টে ছিলেন৷ এখন পুরো বাড়িটিতেই বসবাস করছেন৷
তাঁর ভাই অনন্ত কুমার সিনহা এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন কিনা সে সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি শেখ শাহরিয়ার জামান৷
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সমমনা লোকদের উপস্থিতি এবং বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের কারণেই এসকে সিনহা নিউ জার্সিতে সংবাদ সম্মেলন না করে ওয়াশিংটনে করেছেন৷''