সেকশন আর বেঞ্চের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
১৭ আগস্ট ২০২০দুই হাজারেরও বেশি ‘টাউট বাটপার’ আছে আদালত এলাকায় ৷ আইনজীবীরা বলছেন, দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে৷ অন্য সময়তো বটেই এমনকি করোনাকালের জিজিটাল আদালতেও সেকশন ও বেঞ্চের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির নতুন কৌশল আবিষ্কার করেন৷ শুধু তাই নয়, এটা বন্ধ করতে সেকশনে টোকেন সিস্টেম চালু করা হলে তার উল্টো প্রতিক্রিয়া হয়৷ লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেকশনের কাজে ঢিলেমি শুরু হয়৷
দুর্নীতির যত ঘাট:
উচ্চ আদালতে আপিলসহ যেকোনো মামলা বা আবেদনে হলফনামা (এফিডেভিট) দিতে হয়৷ এই কাজ সেকশনের৷ আর আদালতের বেঞ্চগুলো মামলার তালিকা করে৷ হলফনামার ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে সশরীরে থাকতে হয়৷ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, অনেক সময় তারা হাজির না থেকে সেকশন থেকে লেনদেনের বিনিময়ে হলফনামা করিয়ে নেন৷ আর সেকশনের লোকজন ছাড়াও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে আইনজীবীদের ক্লার্করা৷ আবার হলফনামা বেঞ্চে না গেলে মামলা তালিকায় থাকলেও শুনানি করা যায়না৷ তাই টাকা আদায়ের জন্য হলফনামা তৈরি করে বেঞ্চে পাঠাতে গড়িমসি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে৷
বেঞ্চ অফিসারেরা মামলার তালিকা করেন৷ অভিযোগ, বেঞ্চে মামলার তালিকা হলো টাকা আদায়ের বড় সূত্র৷ শুনানির জন্য মামলা তালিকায় না থাকলে শুনানি হয়না৷ তাই তালিকায় তুলতে টাকা দিতে হয় ৷ শুধু তাই নয়, মামলাটি তালিকার আগে না পরে থাকবে তাই নির্ধারণ করা হয় টাকার বিনিময়ে৷ আবার আদেশ হওয়ার পর লিখিতভাবে তার কপি বের করার ব্যাপারেও আছে লেনদেনের বিষয়৷ কারণ লিখিত আদেশ না পেলে তার কোর্স অব অ্যাকশন শুরু হয় না৷ এটা ঝুলিয়ে রেখেও টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে৷
আইনজীবীদের এইসব অভিযোগের ভিত্তিতে সেকশনে কয়েক সপ্তাহ আগে টোকেন পদ্ধতি চালু করা হয়৷ নিয়ম করা হয়, মামলার হলফনামার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়ে আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবীর ক্লার্ক একটি টোকেন নেবেন৷ আবার সেই টোকেন দেখিয়ে তারা গেটের বাইরে থেকেই কাগজপত্র নেবেন৷ সেকশনের ভিতরে ঢুকবেন না৷ এতে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাথায় বাজ পড়ে সেকশনের কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর৷ যেহেতু স্পিড মানি নাই তাই তারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন৷ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও আচরণবিধি কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান জানান, ‘‘রোববার যে ৪৩ জন ক্লার্ককে আটক করে পরে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তারা মূলত টোকেনসহ কাগজের জন্য ভিড় করেছিলেন৷ সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অভিযান হয়৷ কিন্তু সেকশন থেকে নিয়ম অনুযায়ী হলফনামার কাগজ দিলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না৷’’
আদালতে ‘টাউট বাটপার’:
আদালতে আইনজীবী, তাদের ক্লার্ক, বেঞ্চ এবং সেকশনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পরিচয়পত্র আছে৷ ক্লার্কদের নির্দিষ্ট পোশাকও আছে৷ তবে এর বাইরে আদালত এলাকায় বেশ কিছু লোক সক্রিয় ৷ তারা আইনজীবী অথবা ক্লার্ক পরিচয়ে সেখানে অবস্থান করেন৷ আইনজীবীর পোশাকও তারা ব্যবহার করেন৷ আদালত সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই চক্রটি অনেক বড়৷ তাদের সাথে আবার কোনো কোনো আইনজীবীর সম্পর্ক আছে৷ আইনজীবীদের রুমেও তাদের দেখা যায়৷ অভিযোগ তাদের কেউ কেউ আবার সুপ্রিম কোর্টের আশপাশ এলাকায় চেম্বার খুলেও বসেছেন৷ এই চক্রটি কোনো কোনো আইনজীবীর মক্কেল ধরার কাজ করেন৷ তারা মামলা পরিচালনা, সেকশন ও বেঞ্চের কাজ করে দেয়ার জন্য চুক্তি করেন৷
আরেকটি চক্র আছে যারা আদালতের ভুয়া আদেশ ও ভুয়া জামিন নামা তৈরি করে৷ গত কয়েক বছরে এরকম বেশ কিছু ভুয়া আদেশ ও জামিন নামা ধরা পড়েছে৷ এই চক্রটি আশপাশের সরকারি অফিসেও অবস্থান করে বলে জানা গেছে৷ সুপ্রিমকোর্ট ক্লার্ক (আইনজীবী সহকারী) সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান দাবি করেন, ‘‘এই চক্রের সাথে কতিপয় বেঞ্চ অফিসার যুক্ত৷ তাদের সহায়তা ছাড়া এই জালিয়াতি সম্ভব নয়৷’’ তার কথা, ‘‘আমরা সুপ্রিমকোর্ট এলকায় দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে স্বাগত জানাই৷ কিন্তু যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ আমরা আইন মেনে কাজ করি৷ আমাদের পরিচয় পত্র ও নির্দিষ্ট পোশাক আছে৷’’
ভার্চুয়াল আদালতও দুর্নীতি ঠোকাতে পারেনি:
অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান বলেন, ‘‘আমরা আশা করেছিলাম করোনার সময় যেহেতু ভার্চুয়াল আদালত তাই বেঞ্চ ও সেকশনের দুর্নীতি কমবে৷ কিন্তু তা কমেনি৷’’ সেটার কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, আইনজীবীরা একটি নির্দিষ্ট ই-মেইলে তাদের আবেদন বা মামলা পাঠান৷ আবার ই-মেইলেই জবাব আসে৷ কিন্তু মামলার তালিকা তো বেঞ্চের হাতে৷ তাই দেখা গেছে আর্থিক যোগাযোগ না করলে মামলার তালিকায় নাম উঠিয়ে আদালতের লিংক আর পাঠানো হয়না৷ ফোন করলে ই-মেইল পাওয়া যায়নি বলে নানা অজুহাত দেয়া হয়৷ মোট কথা হলো তারা তুষ্ট না হলে কাজ হয়না৷
এইসব বিষয় নিয়ে এরইমধ্যে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবী সমিতি বৈঠক করেছে৷ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়ার জন্য একটি অভিযোগ বাক্সও রাখা হয়েছে৷ আইনজীবী সমিতি একটি আচরণবিধি কমিটিও করেছে৷
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের মত জায়গায় কোনো অনিয়ম, ঘুস, দুর্নীতি থাকতে পারেনা৷ সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন এবং আইনজীবী সমিতি এব্যাপারে একমত৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে৷’’
এবিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র সাইফুর রহমান জানান, ‘‘প্রধান বিচারপতি সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে যেকোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছেন৷ রোববার অভিযান হয়েছে৷ এখন বিচারপতি ইমান আলী একটি প্রতিবেদন দেবেন৷ তার ভিত্তিকে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’
তিনি বলেন, নিয়ম অমান্য করে সেকশনে ঢুকেছিলো বলে ওই ৪৩ জনকে আটক করা হয়েছিল৷