‘সেল্ফ সেন্সরশিপ' চর্চা করছি: মাহফুজ আনাম
২০ মে ২০১৭মাহফুজ আনাম একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়াদের একজন তিনি৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকুরিসূত্রে বিদেশে কাটিয়েছেন বেশ কয়েকবছর৷ আর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ফেরার পর ১৯৯১ সাল থেকে রয়েছেন ডেইলি স্টার পত্রিকার সঙ্গে৷ গত চব্বিশ বছর ধরে পত্রিকাটির সম্পাদক, প্রকাশক তিনি৷
ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটের (আইপিআই) বিশ্ব কংগ্রেসে যোগ দিতে জার্মানির হামবুর্গ শহরে এসেছিলেন মাহফুজ আনাম৷ বাংলাদেশে সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পরিচিত এই ব্যক্তিত্ব বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলের সঙ্গে ফেসবুক আড্ডায় কথা বলেছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে৷ বাংলাদেশে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাওয়া বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ' চর্চা করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি৷ পরিস্থিতি যে স্বাধীন সাংবাদিকতার অনুকূলে নয়, সেটা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট উঠে এসেছে৷
গত বছরের এক টেলিভিশন টকশো-তে মাহফুজ আনাম বলেছিলেন যে, ২০০৭-২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনা গোয়েন্দাদের দেওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই না করেই প্রকাশ করেছিল ডেইলি স্টার পত্রিকা৷ তিনি মনে করেন যে, সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল এবং সে কারণে তিনি দুঃখিত৷ আনামের এই বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কড়া সমালোচনা করেন৷ ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বর্ষিয়ান এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আশিটিরও বেশি রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মানহানির মামলা করেছিল, যেগুলোতে ক্ষতিপূরণও চাওয়া হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা৷
সেসব মামলার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে মাহফুজ আনাম বলেন যে, মামলাগুলো ‘স্ট্যাটাস কুয়োতে' রয়েছে৷ তাঁর তরফ থেকে সেগুলো বাতিলের উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না, সরকারের তরফ থেকে পুনরায় চালুর উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না৷ সব মামলাই বর্তমানে স্থগিত অবস্থায় রয়েছে৷
তবে এই বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে বলেও জানান মাহফুজ আনাম৷ সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ আলোচিত সময়ে আনামের ভূমিকা নিয়ে অনুসন্ধানের বদলে তাঁর বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপনের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের এই সম্পাদক৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশের সাংবাদিকরা কিন্তু রিপোর্ট করে দেখালো না আমি কতটুকু দোষী বা আমাকে হেয় করার জন্য এসব বলা হচ্ছে কিনা৷ আমার মনে হয়ে এখানে অনুসন্ধানের সুযোগ ছিলো৷'' আগামী বছর সম্পাদক, প্রকাশক হিসেবে পঁচিশ বছরে পা দেবেন মাহফুজ আনাম৷ বর্তমান সময়টা তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কিনা জানতে চাইলে একটু সাবধানে উত্তর দিয়েছেন তিনি৷ জানিয়েছেন, সম্পাদক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর পঁচিশ বছর পর যে অবস্থা তিনি দেখতে চেয়েছিলেন বর্তমান অবস্থা সেরকম নয়৷
বলাবাহুল্য, ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো পত্রিকায় বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায় বলে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল৷ একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্বীকারও করে যে চাপের কারণে পত্রিকা দুটিতে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে ফেসবুক আড্ডায় বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন মাহফুজ আনাম৷ ডয়চে ভেলের দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তিনি৷
বর্তমান সরকার প্রধান তাঁর কড়া সমালোচনা করলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন মাহফুজ আনাম৷ জানিয়েছেন, অতীতের সরকারগুলো চীন বা ভারতের প্রতি সমর্থিত বলে চিহ্নিত হলেও বর্তমান সরকার ভারত, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে যা এক ইতিবাচক ব্যাপার৷ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগেরও প্রশংসা করেন তিনি৷ ভবিষ্যতে ডেইলি স্টার শুধুমাত্র প্রিন্ট সংস্করণের উপর নির্ভরশীল থাকবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পত্রিকাটি ক্রমশ কন্টেন্ট প্রডিউসার হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে যেখানে প্রিন্ট সংস্করণ হবে কন্টেন্ট প্রকাশের একটি মাধ্যম মাত্র৷ মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কন্টেন্ট প্রকাশের হার বাড়ানো হবে বলেও জানিয়েছেন মাহফুজ আনাম৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে তাঁর পুরো আলোচনা দেখতে ক্লিক করুন এখানে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷