চিত্রশিল্পী মাক্স অ্যার্নস্ট
৫ জুলাই ২০১৩বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে কোলোন-প্যারিসে শিল্পী ও লেখকদের এক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল৷ ডাডা এবং পরে স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদী শিল্পের এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ইউরোপে৷ শিল্পীরা এঁকেছেন ফোটোগ্রাফিক স্পষ্টতায়, মগ্নচৈতন্যের অযৌক্তিক দৃশ্য৷ মানুষের অবচেতন মন নিয়ে করেছেন গবেষণা৷ এই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জার্মান চিত্রকর মাক্স অ্যার্নস্ট৷ স্যুরিয়ালিজম শিল্পকলা ধারার এক অগ্রদূত৷ তিনি ছিলেন একাধারে কবি, চিত্রকর, অলংকারক এবং ভাস্কর৷ তাঁর চিত্রকর্মে মূর্ত হয়ে উঠেছে বিস্ময়ভরা পৃথিবীতে পৌরাণিক দানব, কবি, দার্শনিক, পাখি ও নারীর পৃথিবীতে অবাস্তবতা, জাদু, বৃক্ষ, পাথর, পোকামাকড়, পর্বত, অঙ্কশাস্ত্রের মতো বিষয়ে তাঁর পলায়নী যাত্রার আনন্দ৷
পুরো নাম: মাক্সিমিলিয়ান মারিয়া অ্যার্নস্ট
জন্ম: ২ এপ্রিল, ১৮৯১, ব্র্যুল, জার্মানি
মৃত্যু: ১ এপ্রিল, ১৯৭৬, প্যারিস, ফ্রান্স
পেশা: কবি, চিত্রকর এবং ভাস্কর
বাবা: ফিলিপ অ্যার্নস্ট
মা: লুইজে
স্ত্রী: ডরোটেয়া টানিং (১৯৪৬–১৯৭৬), পেগি গুগেনহাইম (১৯৪২–১৯৪৬)
মারি-ব্যার্ট ওরঁশ (১৯২৭–১৯৪২), লুইজে স্ট্রাউস (১৯১৮–১৯২৭)
উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম: দ্য ভার্জিন চ্যাস্টাইসেস দ্য ইনফ্যান্ট জিসাস বিফোর থ্রি উইটনেসেস, বার্ড-হেড, রঁদেভু দেজামি৷
জার্মানির কোলোন ও বনের মাঝখানে ছোট্ট শহর ব্র্যুল-এ বড় হয়েছেন মাক্স৷ বাবা ছিলেন মূক ও বধিরদের স্কুলের শিক্ষক৷ চিত্রাঙ্কনেও দক্ষতা ছিল তাঁর৷ ছিলেন ঘোর ক্যাথলিক৷ বাবার এই ক্যাথলিকপনার বিরুদ্ধে একদিন বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন মাক্স৷ তিনি স্মৃতিচারী বহু টুকরো টুকরো লেখা লিখে গিয়েছেন, যার অনেকটাই নিজের বাবা সম্পর্কে তাঁর ভয়-ভাবনা ও ফ্যান্টাসিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত৷ মনোবিশ্লেষণধর্মী ধ্যান-ধারণার প্রভাবে এগুলোই এক সময় হয়ে উঠেছে তাঁর অঙ্কনশিল্পের জন্য চিত্রকল্পের এক সমৃদ্ধ আকর৷ যেমন ১৯২৬ সালে আঁকা ছবি, যেখানে কুমারী শিশু যিশুকে কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন তিনজন সাক্ষি অঁদ্রে ব্রেতঁ, পল এলুয়া এবং মাক্সের সামনে৷ সে সময় ছবিটি বিতর্কের ঝড় তুলেছিল৷
১৯০৯ সালে মাক্স ভর্তি হন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ তাঁর পাঠ্যবিষয় ছিল দর্শন, মনোবিজ্ঞান ও শিল্পকলার ইতিহাস৷ দর্শনে ফ্রিডরিশ নিচে – যিনি নিৎশে নামেই বেশি পরিচিত – তাঁর ধারণা মাক্স অ্যার্নস্ট-কে বেশ প্রভাবিত করেছিল৷ পড়েন সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর মনোসমীক্ষা বিষয়ক রচনা৷ তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চিত্রশিল্পী হবেন৷ ১৯১৩ সালে বন-এ রাইন অঞ্চলের অভিব্যক্তিবাদী শিল্পীদের চিত্রকর্মের প্রদর্শনিতে তাঁর ছবিও ছিল৷ পরের বছরই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ৷ যুদ্ধে যোগ দিতে হয় তাঁকে৷ আহত হন দু'দুবার৷ ১৯১৯ সালে ফিরে আসেন যুদ্ধ বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে৷ কোলোনে এসেই যোগ দেন ডাডাপন্থী চক্রে৷ এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল শিল্প ও সাহিত্যে যা কিছু সনাতন, যা কিছু প্রচলিত তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যুক্তিতর্ক ও বিধিনিয়মের গণ্ডিকে অস্বীকার করা৷ ১৯২২ সালে মাক্স চলে যান প্যারিসে৷ সেখানে ফরাসি লেখক ও কবি অঁদ্রে ব্রেতঁ ও পল এলুয়া-র সংস্পর্শে আসেন৷ দু'বছর পর প্রকাশ পায় ব্রেতঁ-র বিখ্যাত ‘ম্যানিফেস্টো অফ স্যুরিয়ালিজম' – পরাবাস্তববাদের ইশতেহার৷ অবচেতন মনের গহন থেকে বেরিয়ে আসা শৈল্পিক ও সাহিত্যিক চিন্তার রূপায়নকে কেন্দ্র করে এই ইশতেহার৷ এর মূল জিজ্ঞাসা ছিল ‘কবে আমরা পাব ঘুমন্ত যুক্তিবিদ, ঘুমন্ত দার্শনিক?' এই পরাবাস্তববাদের ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে মাক্সের বেশির ভাগ শিল্পকর্ম৷ অবশ্য এর আগে থেকেই তিনি ছিলেন আভাগার্দ চিত্রকলার পুরোভাগে৷ কাজ করেছেন ‘নতুন পুরাণ' সৃষ্টির লক্ষ নিয়ে৷
তাঁর কোলাজশিল্পের মোটিভে এসেছে কখনও মজাদার কোনো বিষয়বস্তু কখনো ভয়াবহ কিছু৷ তাঁর ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে পাখি৷ কখনো মানব হিসেবে কখনোবা দানব হিসেবে৷ কখনো স্বাধীনতার, মুক্তির প্রতীক আবার কখনো মূর্ত হয়েছে মানবজাতির নিষ্ঠুরতার রূপে৷ ল্যান্ডস্কেপ বা অরণ্য ছিল তাঁর খুব প্রিয় মোটিভ৷ তা এসেছে কখনো আশ্রয়ের প্রতীক হিসেবে, কখনো সংহারী মূর্তি নিয়ে৷ গত শতকের তিরিশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই আসন্ন নাৎসি সন্ত্রাসের আভাষ পাওয়া যায় তাঁর চিত্রকর্মে৷ ৪০ সালে গেস্টাপোর হাত থেকে রক্ষা পেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন অ্যামেরিকায়৷ সেখানেও চলে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যচর্চা৷ প্রায় ১৩ বছর পর আবার ফিরেছিলেন প্যারিসে এবং সেখানেই ছিলেন জীবনের শেষ অবধি৷
পৃথিবীর বিখ্যাত সব মিউজিয়ামের সংগ্রহ তালিকায় রয়েছে তাঁর শিল্পকর্ম৷ ১৯৭৬ সালে, তাঁর ৮৫তম জন্মবার্ষিকীর এক দিন আগে মারা যান শতাব্দীর অন্যতম সেরা শিল্পী মাক্স অ্যার্নস্ট৷