অক্টোবরে সব বিশ্ববিদ্যালয় খোলাও কি সম্ভব?
২৭ আগস্ট ২০২১পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থীর এখনো টিকা দেওয়ার উদ্যোগই নেওয়া হয়নি৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে এমন কোনো সুপারিশও কেউ করেনি৷ ফলে টিকা নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার এই সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবসম্মত হয়েছে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে৷ তবে স্কুল-কলেজ খোলার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশিদ আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আমাদের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে সেই তালিকা ধরে ১৮ বছরের বেশি বয়সের শিক্ষার্থীদের টিকা রেজিষ্ট্রেশন করার সুযোগ আমরা করে দিয়েছি৷ তবে কতজন টিকা নিয়েছেন সেটা তো আর বলা যাবে না৷ কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের টিকার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা যায়নি, এখন পর্যন্ত এমন কোনো সুপারিশও কেউ করেনি৷’’
জানা গেছে, দেশের ৯১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ ভাগ শিক্ষক ইতিমধ্যে টিকা নিয়েছেন৷ তবে শিক্ষার্থীদের কতভাগ টিকা নিয়েছে, সেই তথ্য কারো কাছে নেই৷
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার শর্ত কী?
বৃহস্পতিবার শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্ধ্বতনরা এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যাপারে৷ বৈঠকের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ১৫ অক্টোবরের পর থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আবাসিক হলগুলো খুলে স্বশরীরে ক্লাস নিতে পারবে৷ তবে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার একটি শর্ত রাখা হয়েছে৷’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুসারে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নীচে না নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না৷ বর্তমানে দেশে সংক্রমনের হার ১৫ শতাংশের নীচে৷ তাহলে কি এই শর্ত শিথিল করা হয়েছে? করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কারিগরি কমিটি থেকে আমরা এমন কোনো সুপারিশ করিনি৷’’ জানা গেছে, টিকা দেওয়ার ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নীচে নামার শর্তটি বিশ্ববিদ্যালয় খেলার ক্ষেত্রে রাখা হয়নি৷
স্কুল-কলেজ খুলবে কবে?
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে৷ সেই বৈঠকেই স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ আমরা পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, এখন সিদ্ধান্ত পেলেই খোলা হবে৷’’ কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘স্কুল-কলেজ খোলার জন্য আমরা একটা গাইড লাইন তৈরি করেছি, সেই অনুযায়ী সবাই কাজ করবেন৷’’
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, স্কুল খোলার আগে জাতীয় কারিগরি কমিটির মতামত চাওয়া হবে৷ কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নীচে না নামলে স্কুল-কলেজ খোলা যাবে না৷ কিন্তু মন্ত্রণালয় সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নীচে নামলেই স্কুল-কলেজ খোলার পক্ষে৷ এজন্য কারিগরি কমিটি যে সুপারিশ করবে সেটাই বাস্তবায়ন করা হবে৷
কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা এখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে চাই না৷ খালি স্কুল-কলেজ খুলে দিলে তো হবে না৷ এই বাচ্চাগুলো কিভাবে স্কুলে যাবে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ অনেক বাচ্চা মায়ের হাত ধরে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যায়৷ আমরা কি ফুটপাতগুলো পরিস্কার করতে পেরেছি? এখনো অনেকেই মাস্ক না পরে ফুটপাতে আড্ডা দিচ্ছে৷ বাচ্চাগুলোর মধ্যে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?’’
জাতীয় কারিগরি কমিটির সুপারিশ কী?
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা জাতীয় কমিটির থেকে বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত করতে হবে৷ ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর আগে আবাসিক হলগুলো খুলে দিতে হবে৷ কয়েকদিন আগে দেখবেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, হল খোলা হবে না, কিন্তু পরীক্ষা নেওয়া হবে৷ উনারা কি শিক্ষক, না রাজনীতিবিদ? ১৮-১৯ বছরের বাচ্চা ছেলে-মেয়ে গ্রাম থেকে এসে ঢাকায় কোথায় থাকবে? তাদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা কী হবে? এগুলো বিবেচনা না করেই উনারা একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন৷ আমরা বলছি, ক্লাস-পরীক্ষা নিতে হলে আগে হল খুলতে হবে৷ এগুলো করতে গেলে তো উনাদের একটু কষ্ট করতে হবে, সেটা উনারা করতে চান না৷ আর স্কুল-কলেজ খোলার ব্যাপারে আমরা এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাইনি৷’’
শিক্ষাবিদরা কী বলছেন?
এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতেই হবে৷ অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ সরকার আসলে এদিকে খুব একটা নজর দেয়নি৷ শিল্প কলকারখানা খোলার ব্যাপারে সরকার যতটুকু মনোযোগী, ততটুকু মনোযোগ এদিকে নেই৷ আমি মনে করি, শিক্ষকদের একটু কষ্ট করতে হবে৷ এক শিফটের শিক্ষার্থীদের দুই ভাগ করে দুই শিফটে ক্লাস নিতে হবে৷ এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমার মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবে না৷’’
আরেকজন শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা প্রথম থেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোচ্ছি৷ একটা ক্লাসে সে কিছু পড়লোই না, তারে আমরা অটোপাস দিয়ে পরের ক্লাসে তুলে দিলাম৷ এটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি৷ দেখেন এইচএসসিতে যাদের অটোপাস দেওয়া হলো তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে? আবার এবারও যদি অটোপাস দেন তাহলে দুটো ব্যাচ একসঙ্গে কীভাবে হবে? আমরা বলেছিলাম পর্যায়ক্রমে ক্লাস শুরু করতে৷ সিলেবাস একটু কাটছাঁট করে সবাইকে মূল শিক্ষাটা দিয়ে তারপর পরের ক্লাসে ওঠাতে৷ সেটা তো হয়নি৷ তারপরও বলবো, এক ক্লাসের ছাত্রদের দুই ভাগ করে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে৷ তা না হলে একটা জেনারেশন কিন্তু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে৷’’