অক্টোবরফেস্টে একদিন
৩ অক্টোবর ২০১৭বড় এক সাংস্কৃতিক উৎসব ৷ আমার নিজেরই এক সময় মনে হতো, কেবল বিয়ার খেয়ে হুল্লোড় করতে সারা দুনিয়া থেকে মানুষ অক্টোবরফেস্টে কেন আসে? কী এমন বিশেষত্ব আছে এখানে?
সত্যি বলতে এই ফেস্টের অন্যতম অনুসঙ্গ বিয়ার, কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে বিয়ার পান করে উল্লাস করা ছাড়াও আরও যে কত কিছু করার আছে এখানে, সেটি কেবল স্বশরীরে উপস্থিত থাকলেই বোঝা যায়৷
সব বয়সিদের চাহিদা মতো বিনোদনের আয়োজনই আমার দৃষ্টিতে এই মেলাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে৷
দুইশ' বছরের বেশি সময়ের পুরনো একটি উৎসব এত দিন পরেও এতখানি সতেজ থাকাটা সহজ কথা নয়৷ বাভারিয়া রাজ্যের রাজধানী মিউনিখ শহরের প্রাণকেন্দ্রে হয় এই উৎসব৷ নতুন শহরে পা রেখেই যেন ফেস্টের ভেন্যু খুঁজে পেতে কোনো জটিলতা না হয়, সেজন্য শহরের প্রধান পরিবহন স্টেশন থেকেই মানুষ নির্দেশনা পেতে শুরু করে কীভাবে ফেস্টে যেতে হবে৷ স্টেশন থেকে উৎসবস্থল পর্যন্ত পথে কয়েক হাত পর পর সড়কের ওপর সাদা চুনকালিতে ‘অক্টোবরফেস্ট' লিখে তীর চিহ্ন দেয়া৷ ফলে একজন মানুষও দেখলাম না, যার কোনো সমস্যা হচ্ছে ভেন্যুতে পৌঁছাতে৷ একটি আয়োজন কতটা গোছানো হতে পারে, তার নমুনা পেলাম সকাল সকাল হোটেল ছেড়ে পথে নামতেই৷
হাজার হাজার মানুষের স্রোতে মিশে গেলাম আমিও৷ উৎসব শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে শেষ সময়ের ভীড়৷ হাজার বললে বোধহয় কমই হয়, কারণ, প্রতিবছর এই উৎসবে যোগ দেয় প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ মানুষ৷
পুরোটা পথ জুড়ে এ্কই পোশাক পরে সবাই হেঁটে চলেছে৷ ছেলেদের পোশাকের নাম ‘লেডারহোসে'৷ এটি মূলত চামড়া দিয়ে তৈরি হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট৷ আর চামড়ারই বেল্ট উঠে গিয়েছে কাঁধ পর্যন্ত৷ কোমরে আর বুকের কাছে আড়াআড়ি করে অবশ্য বেশ কারুকাজ আছে৷ সাথে চেক শার্ট৷ আর মেয়েদের পোশাকটির নাম ‘ড্রিনডেল'৷ ওপরে সাদা টপস, নিচে পছন্দসই ফ্রক৷ ফ্রকের ওপরে মানানসই অ্যাপ্রন৷ এই পোশাক এই এলাকার প্রাচীনতাকে মনে করিয়ে দেয়, উৎসবের আভিজাত্যও বাড়ায় একইসাথে৷
মেলা প্রাঙ্গনে বড় ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করা যায় না৷ সাংবাদিক পরিচয়পত্র দেখানোর কারণে নিজের ব্যাগ নেয়ার অনুমতি পেলাম নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে৷ এরপরই শুরু হলো মেলা দেখা৷
আমার ধারণা ছিল, এই মেলায় আমি তরুণদের দেখা পাবো সবচেয়ে বেশি৷ শিশু আর বুড়োদের খুব একটা চোখে পড়বে না৷ আমার এই ধারণা পুরোপুরি মিথ্যে প্রমাণ করে বিপুল সংখ্যক শিশুর দেখা পেলাম৷ আট/দশ বছর বয়সি শিশু যেমন আছে, তেমনি বুকের মধ্যে আগলে রাখতে হয় তেমন শিশুদের নিয়েও বাবা-মায়েরা এসেছেন৷
৬ বছরের জেনিয়াকে নিয়ে বাবা জেরন এসেছেন৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘এতটুকু মেয়েকে নিয়ে এই ভীড়ের মধ্যে কেন এসেছেন?''
বললেন, ‘‘ও আসতে চায়, দেখতে চায় এখানে কী হচ্ছে৷ এইখানে এতসব রাইড সেগুলোতে উঠতে চায়৷ আর তাছাড়া এখানে এলেই তো এই ঐতিহ্য ও জানতে পারবে, তাই না?''
আসলেই তো, ঘরে বসে বই পড়লেই তো আর সব জানা হয় না৷ মেলায় যে প্রায় একশ' রকমের রাইড আছে, সেটা তো আমারও জানা ছিল না৷ ছোটদের, বড়দের সবার জন্য আলাদা আলাদা৷ বড়দের কিছু রাইড আমার কাছে অন্তত ভীষণ ভীতিকর৷ যদিও সাহস করে দেখলাম অনেকেই এগোচ্ছেন সেদিকে৷ কোনোটা ওপরে তুলে আছড়ে ফেলছে, কোনোটা অসম্ভব গতিতে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে, কোনোটা আবার ডান-বাম, ওপর-নিচ সব দিকে মোচড় দিচ্ছে৷ এসব করার সময় ভয়ে সবাই চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে, নামার সময় আবার দেখি দিব্যি হাসিসুখে নেমে আসছে৷
একইভাবে বুড়োরাও কিন্তু ঘরে বসে নেই৷ মিউনিখেরই এক দম্পতির সঙ্গে কথা হলো৷ গত প্রায় ৪০ বছরে প্রতিবারই কয়েকবার করে তারা আসেন অক্টোবরফেস্টে৷ ডিয়েটার মিনশ নামে পরিবারের কর্তাটি জানালেন, ‘‘অল্প বয়সে যেদিনই সময় পেতাম, চলে আসতাম৷ এখন আর পারি না৷ তা-ও ৩-৪ বার তো আসা হয়ই৷ এটা তো আমাদের এতিহ্য৷ এমন আনন্দের পরিবেশ তো আর পাওয়া যায় না৷''
সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে আসা দুই বন্ধু মাইকেল আর জেনিফারের সাথে কথা হলো্৷ বললো, তাদের দেশেও এই অক্টোবরফেস্টের আদলেই এখন উৎসব শুরু হয়েছে৷ কিন্তু এটির কথা তারা এত শুনেছেন, তাই পরিকল্পনা করে এবার চলে এসেছেন৷
সার্ভিয়া থেকে আয়েলডিন এসেছেন তার বন্ধুদের বড় একটি দলের সাথে৷ এর আগেও অনেকবার এসেছেন বলে জানালেন৷ এতবার কেন আসেন? বললেন, ‘‘খুব ভালো লাগে৷ বিয়ার, রাইড, খাবার...সব মিলিয়ে পুরো পরিবেশটাই আমার খুব ভালো লাগে৷''
এই এক বিশেষ দিক নজরে পড়লো৷ ছেলেদের দল, মেয়েদের দল, ছেলে-মেয়ে মেলানো দল, যুগল, শিশুসহ পরিবার, বয়স্ক কয়েকজন মিলে, বয়স্ক যুগল....আর কোনো ক্যাটাগরি পাচ্ছি না যাদের বাদ দেয়া যায় ৷ অর্থাৎ সবাই আছেন এই মেলায়৷
মেলায় অসংখ্য স্যুভেনিরের দোকান, নানা রকম পণ্যের পসরা আর বাভারিয়ার বাহারি সব খাবার৷ মূল ঐতিহ্য হলো, আস্ত মুরগির রোস্ট, সাথে মচমচে নোনতা রুটি যার নাম ‘ব্রেৎসেল'৷ বিয়ার, সসেজ আর সর্ষের চাটনির সঙ্গে পরিবেশন করা হয় বাভারিয়ার ঐতিহ্যবাহী এই খাবার৷ ‘ভাইসভুর্স্ট' সাদা রংয়ের এক সসেজ৷ ‘ভাইস' মানে সাদা আর ‘ভুর্স্ট' মানে হলো সসেজ৷ আসলে মাংসের কিমা সেদ্ধ করার পরে এমন সাদা হয়ে যায়৷ এই খাবার অবশ্য যে কোনো সময় খাওয়া যায় না৷ বাভারিয়ানরা শুধু সকালে খান এই খাবার৷ নানান রকমের সসেজ আর রুটি খুব পছন্দ করেন সবাই৷
ন্যুরেমবার্গ থেকে সাত-আটজন বন্ধুর এক দলের সাথে এসেছেন জেনি৷ জিজ্ঞাসা করলাম, এখনকার কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লাগে আর কোনটা লাগে না? জেনির জবাব, ‘‘এটা একটা অসাধারণ জায়গা৷ অবশ্যই পানীয় সবচেয়ে ভালো লাগে৷'' তবে অনেক চিন্তা করেও খারাপ লাগার মতো কিছু বের করতে পারলন না৷
স্বাভাবিকভাবেই খুব কৌতুহল হচ্ছে পানীয় পানের মহড়া দেখার্৷ যেই বিয়ারের কথা এত শুনলাম, কোথায় সেই বিয়ার? মজার ব্যাপার হলো, পুরো মেলায় স্বাভাবিক পরিবেশ ধরে রাখতে বিয়ার পানের জন্য একপাশে আলাদা করে বেশ কিছু বড়ো-সড়ো তাঁবু আছে৷ সেখানে একবারেই হাজার খানেকের বেশি মানুষ বসতে পারে৷ প্রত্যেককে যে মগে বিয়ার পরিবেশন করা হচ্ছে, তা আসলে এক লিটারের জগের সাইজের এ্কটি মগ৷ প্রতিবছর লাখ লাখ লিটার বিয়ার কেবল এই উৎসবেই বিক্রি হয়৷ দামটা অবশ্য বেশ চড়া৷ স্বাভাবিক সময় এক বা দুই ইউরোতে যা পাওয়া যায়, এই উৎসবে এই এক লিটার বিয়ারের দাম পড়ে এগারো ইউরো৷ প্রায় হাতির সাইজের ঘোড়া আর তার গাড়িতে কাঠের ড্রামে ভরে ভরে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে দেয়া হয় বিয়ার৷ খুবই রাজকীয়ভাবে সাজানো এই ঘোড়া আর গাড়ি দুটোই৷
বিশাল তাঁবুর ভেতরে লাইভ সঙ্গীত পরিবেশনা চলছে৷ আর সবাই বসে নানান পদের খাবার খাচ্ছেন, সাথে অবশ্যই বিয়ার৷ কেউ নাচতে চাইলে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে নাচ শুরু করতে পারবেন, তবে অকারণে দাঁড়াতে পারবেন না৷ সঙ্গীত, খাবার, আড্ডা...কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা৷
বিকেল হতেই মানুষ যেন উপচে পড়তে শুরু করলো মেলা প্রাঙ্গনে৷ বাভারিয়া রাজ্যের রাজা লুডভিগ কী রাজকুমারী থেরেসে'কে বিয়ের সময় ভুলেও ভেবেছিলেন যে, তাদের বিয়ের উৎসবকে মনে করে সেই ১৮১০ সাল থেকে এখন অবধি মানুষ একইরকম উৎসব করে যাবে!
প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহান্ত পর্যন্ত চলে জার্মানির অন্যতম এই উৎসব ‘অক্টোবরফেস্ট'৷ ভালো কথা, ফেস্টে প্রবেশ করতে কিন্তু কোনো টিকিটের প্রয়োজন হয় না৷ কেবল রাইডগুলো চড়তে টিকিট করতে হয়৷
শেষ বিকেলের একপশলা বৃষ্টি আর শীত দর্শনার্থীদের আগ্রহে এতটুকুও ভাটা ফেলতে পারলো না৷ তবে সারাদিন ঘুরে আমিই বরং খানিকটা ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার পর আলো ঝলমলে মেলা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম৷ পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, এতগুলো মানুষ একসাথে অথচ কোনো গোলযোগ নেই৷ মেলার ভেতর তো একটা পুলিশও নজরে পড়লো না! আবার নাকি মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে...কীভাবে সম্ভব! নিজেদের সংস্কৃতিকে কত সুন্দর করেই না উদযাপন করছে এ দেশের মানুষ! সাথে যোগ করতে পেরেছে বাকি দুনিয়ার অসংখ্য মানুষকেও৷