অতীতের মূল্য জানে জার্মানি
৪ এপ্রিল ২০১৭সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলতে জার্মানির মতো একটি সমৃদ্ধিশালী দেশে যে কী বোঝায়, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বোধহয় পথে-ঘাটে বহু পুরনো বাড়ির গায়ে ‘ঐতিহাসিক ভবন' হিসেবে লটকে দেওয়া সরকারি তকমা বা ফলক৷ সে ধরনের বাড়ির সংখ্যাও খুব কম নয়৷
বলতে কি, ইউরোপের আবহাওয়ার কারণেই হয়ত এদেশে যুগের পর যুগ চলে যায়, কিন্তু বাড়িঘরের তেমন ক্ষতি হয় না৷ বাড়িঘর তৈরিতে পাথর ও কাঠের – কড়িকাঠের – ব্যবহার বেশি; সেটাও একটা কারণ হতে পারে৷ আর্দ্রতা কম বলে হয়তো ইট বা পলেস্তারায় নোনা ধরে না৷
দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই আইন করে ঐতিহাসিক ভবন ও স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির সংরক্ষণ শুরু হয়েছে৷ আজও স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণের ব্যাপারটি কেন্দ্রের নয়, রাজ্যগুলির হাতে – তারাই এই সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে এবং আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সেই আইন বলবৎ করে৷
তৃতীয়ত, স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ হলো এমন একটি বিষয়, যেখানে সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই, উভয়পক্ষই এ বিষয়ে পুরোপুরি উদ্বুদ্ধ, এমনকি জনসাধারণের মধ্যে যারা বিত্তশালী নন, তারাও৷ হয়ত এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠক্রমে এমন কিছু আছে, যা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেয় যে, তোমার অতীত তোমার সত্তার অঙ্গ, অতীত ছাড়া তুমি নেই, তোমার জাতি নেই, পরিচয় নেই৷
দশ লাখ ‘ডেঙ্কমাল'
তাই জার্মানিতে সরকারিভাবে স্বীকৃত ও নথিভুক্ত ‘ডেঙ্কমাল' বা স্মৃতিসৌধের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ৷ এর মধ্যে পড়ে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, অসংখ্য গির্জা – অন্যদিকে চাষবাসের খামারবাড়ি থেকে শুরু করে কারখানার শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা; সেই সঙ্গে দুর্গ-প্রসাদ, উদ্যান বা বাগান, শিল্পকারখানা বা সরকারি ভবন: এ সবই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ৷
এই সব স্মৃতিসৌধের মধ্যে বেশ কিছু স্মৃতিসৌধ কিন্তু বেসরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে – তার মধ্যে কিছু পুরনো বাড়ি হয়ত ভাড়া দেওয়া হয়েছে: কিন্তু সেগুলোরও তো মেরামতি, রক্ষণাবেক্ষণের দরকার৷ বাইরে থেকে সে সব বাড়ি বদলানো চলবে না; ভেতরে রদবদল করতে গেলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে৷
বাড়ির মালিকরা যাতে তাদের ‘স্মৃতিসৌধগুলোর' ঠিকমতো দেখাশোনা করেন, সেজন্য তাদের কর ছাড় দেওয়া হয়: স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ আইনে সুরক্ষিত বাড়িগুলির দেখাশোনায় যা খরচা হবে, তার একাংশ আয়কর হিসেবের সময় বাদ দেওয়া চলবে৷
ইউনেস্কোর তালিকায়
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টে যে ৮৯০টি ‘মনুমেন্ট' বা স্মৃতিসৌধ আছে তার মধ্যে ৩৩টি হল জার্মানিতে৷ অর্থাৎ যে ১৮৬টি দেশ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছে, স্বীকৃত হেরিটেজ সাইটের সংখ্যার বিচারে প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে পড়ে জার্মানি৷
বিখ্যাত, সমাদৃত ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের কথা উঠলে বলতে হবে যে, এক্ষেত্রে জার্মানি ইটালি বা ফ্রান্সের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে; কিন্তু জার্মানির মতো এত বেশি স্বীকৃত ও সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ আর কোনো দেশে নেই৷ এবং এই সংখ্যার আসল গুরুত্ব হলো এই যে, এই সংখ্যা থেকে দেশের সামগ্রিক সচেতনতার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়: অর্থাৎ দেশের মানুষরা তাদের নিজেদের ইতিহাস, সেই ইতিহাসের বিভিন্ন নীরব সাক্ষী ও সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে ঠিক কতটা সচেতন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন মন্তব্যে৷