নিদর্শন অনেক, কিন্তু সংরক্ষণ নেই
৩ এপ্রিল ২০১৭এ সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে দু'টি আবার বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ৷ আরো পাঁচটি নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকাভূক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আতাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের মূল সংকট লোকবল৷ মাত্র ৪৩০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়ে কাজ করছি আমরা৷ তাই কোনো কোনো নিদর্শন রক্ষায় আমরা মাত্র একজন লোক নিয়োগ করেছি এমন উদাহরণও আছে অনেক৷ বাংলাদেশে এখন তালিভুক্ত যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে তা সংরক্ষণেই কমপক্ষে পাঁচ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী প্রয়োজন৷''
আর মাটির নীচে যেসব নিদর্শন আছে সেগুলোর সম্পর্কে ধারণা করা যায়, কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়া সম্ভব নয়৷ লোকবল সংকটের কারণে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনো চিহ্নিত করা যায়নি৷
প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে৷ তার ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশ অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী৷ আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময়ে এ দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসক শ্রেণি গড়ে তোলে অসংখ্য ইমারত, নগর , প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার স্তূপ ও সমাধি সৌধ৷ এ সব ঐতিহ্যের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখেযোগ্য সংখ্যক সংস্কৃতি চিহ্ন এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজো টিকে আছে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সমধিক পরিচিত৷''
এই ওয়েবসাইটে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় কয়েকটি পুরাকীর্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে – মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সীতাকোট বিহার, কান্তজীর মন্দির, ছোট সোনা মসজিদ, ষাটগম্বুজ মসজিদ, ভাসুবিহার, বিহার ও বারবাজার, লালবাগ দুর্গ৷
বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে বৌদ্ধ, মুসলিম এবং হিন্দু শাসনামলের পুরার্কীর্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে৷ তবে খননের অভাবে আরো অনেক নিদর্শন সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত জানা যাচ্ছে না৷ তবুও অধিদপ্তর সীমিত অর্থ কাজে লাগিয়ে প্রতি বছরই খনন কাজ করছে৷ চলতি বছরেও খনন কাজ চলছে৷ প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে সুলতানী আমলের ৪২ গম্বুজ মসজিদ আবিষ্কার করা হয়েছে৷ নরসিংদির উয়ারী বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে দু'টি অতি প্রাচীন গ্রাম আবিষ্কারের ঘটনা বাংলদেশে বেশ আলোচিত৷ দু'টি গ্রামেই খননের পরে প্রায় দুই হাজার বছর আগের স্থাপনা ও প্রত্নসম্পদ পাওয়া গেছে৷ যার মধ্যে রয়েছে ছাপযুক্ত মুদ্রা, মূল্যবান পাথরের গুটিকা, পুঁতি, লোহার তৈরি হাতকুড়াল ইত্যাদি৷
বিশ্ব ঐতিহ্য
বাংলাদেশের যে দু'টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সে দু'টি পুরার্কীর্তি হলো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এবং বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ৷
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন৷ ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই কীর্তি আবিষ্কার করেন৷ ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়৷ পাহাড়পুর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার৷ আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে৷ এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের ধর্মচর্চার কেন্দ্র ছিল৷ শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো অনেক দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন৷ খ্রিষ্ট্রীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান৷
উলঘ খান-ই-জাহান ১৫ শতকের দিকে বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন৷ এই প্রত্নস্থানটি ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়৷ ওই এলাকায় বেশ কিছু মসজিদ, স্থাপনা, সমাধি, পুকুর ও ঢিবি পাওয়া গেছে৷ ষাটগম্বুজ মসজিদ এদের মধ্যে অন্যতম৷ মসজিদটিতে ৮১টি গম্বুজ রয়েছে৷ মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া৷ দেয়ালগুলো ৮.৫ ফুট পুরু৷ জনশ্রুতি আছে, হযরত খানজাহান (র.) ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের সব পাথর সুদূর চট্টগ্রাম, মতান্তরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন৷
ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়৷ এ বিশাল মসজিদের চারদিকে প্রাচীর ৮ ফুট চওড়া, এর চার কোণে চারটি মিনার আছে৷ দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম ‘রোশনাই কুঠির' এবং এ মিনারে উপরে ওঠার সিঁড়ি আছে৷ মসজিদটি ছোট ইট দিয়ে তৈরি৷ এর দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট, প্রস্থ ১০৮ ফুট, উচ্চতা ২২ফুট৷ মসজিদের সামনের দিকের মাঝখানে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে৷ মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে৷
এছাড়া মাহাস্থানগড়, লালমাই ময়নামতি গ্রুপ অফ মনুমেন্টস, লালবাগ দুর্গ, হলুদ বিহার ও জগদ্দল বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে৷
ড. আতাউর রহমান বলেন, ‘‘এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রত্যেকটিই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার যোগ্য৷ মধ্যযুগের মহাস্থানগড়ে আমরা আড়াই হাজার বছর আগের লিখিত দলিল পাচ্ছি৷ ব্রাহ্মীলিপির নিদর্শন এখানে রয়েছে৷''
‘মহাস্থান' শব্দের আভিধানিক অর্থ বিখ্যাত স্থান৷ কেউ কেউ মনে করেন যে, স্থানটির আসল নাম ‘মহাস্নান' বিখ্যাত স্থানের জায়গা৷ প্রাচীন পুন্ড্রনগর আজ মহাস্থানগড়ের ভূ-গর্ভে প্রোথিত৷ এ স্থান বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ৷ প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রীষ্টিয় ১৫শ' শতকের মধ্যে এই নগর এক সমৃদ্ধশালী জনপদ হিসেবে গড়ে উঠেছিল৷ করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরের এই প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান বগুড়া জেলার এক গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি৷
বিশ্ব ঐতিহ্যের আরেক নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ৷ এই কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম৷ মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন৷ ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান৷ ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গকে প্রাচীন সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়৷ নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয়৷
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব একটি বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়৷ এই বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বেই ২০০০ সালে উয়ারি বটেশ্বরের খনন কাজ শুরু হয়৷ এখনো চলছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য খনন কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ বাংলাদেশে যে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ হয় তা অনেকাংশেই বৈজ্ঞানিকভাবে হয় না৷ আর এ কাজের জন্য দক্ষ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকবলও আমাদের নেই৷''
তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো জরিপ এখনো হয়নি৷ তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার যোগ্য অনেক নিদর্শন আমাদের আছে৷ ময়নামতি, পাহাড়পুর, উয়ারি বটেশ্বর এর মধ্যে অন্যতম৷ আর পাহাড়পুর এবং ষাটগম্বুজ মসজিদ এরইমধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ৷ আরো অনেক নিদর্শন আছে যা আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারি, জানাতে পারি, কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে একটি মনুমেন্টও বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়নি৷ শুধু আমরা উয়ারি বটেশ্বরে লোটাস ট্যাম্পেলকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করছি৷''
অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আতাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন৷ পুরাকীর্তি সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ ব্যয়বহুল৷ তবুও আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করছি৷ তবে সেটা কোনোভাবেই সন্তোষজনক তা আমি বলবো না৷''
বাংলাদেশে পুরাকীর্তি জাদুঘরও আছে৷ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এ রকম জাদুঘর মোট ১৭টি৷ এ সব জাদুঘরের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রদর্শিত হয়৷ আর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি খনন কাজ শুরু করেছে৷ এখানে মৌর্য সভ্যতার অনেক নিদর্শন আছে বলে জানান সুফি মোস্তাফিজুর রহমান৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷