কবে থেকে? শব্দটি কবে থেকে দুর্বলকে ঘায়েল করার অব্যর্থ অস্ত্র হয়ে উঠেছে। হ্যা নিশ্চয়ই দুর্বলকে ঘায়েল করার অস্ত্রই। অবশ্যই গোষ্ঠীহীন নিঃসঙ্গ অবল মানুষকে ঘায়েল করার অস্ত্র। অন্তত নিকট ইতিহাস তাই বলে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুগের উত্থানের পর এই বঙ্গভূমি, স্বাধীন বাংলাদেশে যতোগুলো হাতে গোনা অপমানকর সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়েছে তার প্রায় সব কয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাসে অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার কারণে।
সেই স্ট্যাটাস সত্যি কি মিথ্যা,ফেইক আইডি থেকে দেয়া নাকি সত্যি, আদৌ কি কেউ দুঃসাহস করেছে মৌচাকে ঢিল দেয়ার, এসবের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের ধৈর্য কেউ দেখায়নি। সময়ের সুবিচারের জন্য অপেক্ষা করেনি। তার আগেই রামুর বৌদ্ধবিহার পুড়ে ছাই ছাই হয়ে গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পাড়ার পর পাড়ায় ম্যাসাকার ঘটে গেছে।
এই প্রতিক্রিয়ায় বিস্রস্ত হয়েছে সময়। কলংকিত হয়েছে ইতিহাস।
অনুভূতি উঁচুমাত্রার সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া। মানুষে মানুষে তার কমবেশি হয়। ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হয়। এবং এই অনুভূতি খুবই স্পর্শকাতর ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া। একই ঘটনায় দুজন ব্যক্তির অনুভূতির তীব্রতা দুই রকম হতে পারে। প্রকাশ এবং প্রতিক্রিয়াও দুরকম হতে পারে স্বাভাবিকভাবেই। অনুভূতি মানুষকে মানবিক করে,সহনশীল করে,সহযোগী এবং সহমর্মি করে। কিন্তু বর্তমানে "অনুভূতিতে আঘাত" শব্দটি হয়ে উঠেছে আতঙ্কের নাম। মানুষের জন্য মানুষের অনুভূতি মানবিকতায় আর্দ্র না হয়ে হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়ায় উদ্ধত।
'অনুভুতিতে আঘাত' নানাজনের ক্ষেত্রে, নানাভাবে এবং নানা মাত্রায় ক্রিয়াশীল হয়। মূলত সংখ্যাগুরুর 'অনুভূতিতে আঘাত' সর্বদা সংখ্যালঘুর চেয়ে হাজারগুন তীব্র।ক্ষমতাবানের অনুভূতির তীক্ষ্ণতা ক্ষমতাহীনের চেয়ে লক্ষগুণ ক্রিয়াশীল।
সম্প্রতি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া এক ছাত্রের সাক্ষাৎকারের সূত্রে অনুভূতিতে আঘাত বিষয়টি আবার আলোচনায়।
প্রথম হওয়া ছাত্রটি জীবনের সব সাধ আহ্লাদ ত্যাগ করে লেখাপড়া করেছে বিধায় ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। একজন যুবকের যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মের সাথে আপস করে একাডেমিক পড়ালেখাকে ধ্যানজ্ঞান করে ভর্তি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভের ঘটনাটি দু পক্ষের যুক্তিতেই হয়তো যুক্তিসঙ্গত। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে যেমন ভাবি,একজন শহীদ রুমী আমার কাঙ্ক্ষিত আদর্শ সন্তান। বিদেশে পড়াশোনা করে দেশকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সেবা দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু ভবিষ্যতে কী পারবে কিংবা কী পারবে না, না ভেবে সময়ের প্রয়োজনে যে দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
অন্যজন আবার এটাও ভাবতে পারেন যে,পড়ার বয়সে একটা ছেলে কেবলই একাডেমিক পড়া পড়বে এটাই স্বাভাবিক। দিন দুনিয়ার খবর তার না নিলেও ক্ষতি নেই।
কোনো দৃষ্টিকোন থেকেই ভাবা দোষের নয়। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে তুমুল তর্ক বিতর্ক হতে পারে। কোনো পক্ষই এবসোলিউট নাও হতে পারে।আলোচনা ডালপালা ছড়াতে পারে। কিন্তু ঐ যে, অনুভূতিতে আঘাত। এই সুস্থ আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে "অনুভূতিতে আঘাত"। এই আঘাত আবার দু পক্ষের লেগেছে। প্রথমত যারা বুয়েটের পড়ুয়া ছাত্র, দ্বিতীয়ত যারা নামাজি। দ্বিতীয় পক্ষের অভিযোগ, ছেলেটি নামাজ পড়ে বলেছে বলেই নাকি এতো আলোচনা।
যখন কোনো অনুভূতির আলোচনা ধর্মে পর্যবসিত হয়,তখন আলোচনা দীর্ঘায়িত করার পথ রুদ্ধ হয়।কেননা ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এক অনুভূতির আঘাত আবার আলোচনার সূত্র ধরে আরেক অনুভূতি আঘাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।যার পরিণতি নিকট অতীতে আমরা বেশ কয়েকটি দেখেছি।
অথচ এই যে বছর বছর জিপিএ ফাইভ নামক লোভনীয় লক্ষ্যের লক্ষ্যে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা,কোচিংসেন্টার,প্রশ্ন ফাঁস, নকলের বাড়াবাড়ির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিযোগিতা এসবই তো ভালো ফল আর ভালো চাকরির উদ্দেশ্যেই। ভালো ফল মানে ভালো চাকরি, ভালো চাকরি মানে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।
আমাদের সমাজতাত্ত্বিকেরা একথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন যে,ভালো ফল, ভালো চাকরি মানে ভালো মানুষ নয়।আমাদের দরকার ভালো মানুষ। এই একাডেমিক পড়াশোনা কেন্দ্রিক জীবন, জীবিকা কেন্দ্রিক দৌড়ানো মানুষগুলো খুব কমই দেশ আর জাতির কল্যাণে কাজে এসেছে। তারা গড়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক আর আত্মস্বার্থবাদী প্রজন্ম হিসাবে। যারা সবকিছুর অর্থনৈতিক বিনিময় মূল্য খোঁজে। যাদের অভিধানে স্বেচ্ছাশ্রম বা পরোপকারী বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই। আমরা তো সামষ্টিক ভাবে এই আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম নিয়ে হতাশাগ্রস্ত।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে,ছেলেমেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা কিংবা বাসনা কি তবে ভুল? বিশেষত সেই দেশে,যে দেশে মেধাবীর মেধা পরাজিত হয় আর্থিক সংগতি কিংবা ক্ষমতার কলকাঠির যথেচ্ছ ব্যবহারে। যেখানে যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা পর্যদুস্ত হয় অনিয়ম আর দুর্নীতির পাতানো জালে।
একটি জাতি, অর্ধশতক অতিক্রান্ত হয়েছে যার স্বাধীনতা অর্জনের। পরাধীনতার রাজনৈতিক উপজাতের ভোগান্তির চেয়ে অধিক সংগ্রাম মুখর ছিলো যাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংকট। অনাবৃষ্টি,ফসলহীনতা,অভাব,দারিদ্র,ক্ষুধা ছিল যাদের নিত্যসঙ্গী। ছিল ভূমির মালিকদের জোর জবরদস্তি, অত্যাচার নিপীড়ন। স্বাধীন দেশে তাদের প্রজন্ম যদি উঠে দাঁড়াতে চায়, নিজের মেধা আর যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা খুঁজে নিতে চায় তবে কি তাকে খুব দোষ দেয়া সঙ্গত?
মোটেই না। মূলত সামাজিক অনাচার,অর্থনৈতিক অনিরাপত্তা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে এই সমাজের সামাজিক বিকাশ বিকৃত হয়েছে। যে সামাজিক বিকাশে কোনো মানুষের নিরাপত্তা নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই,জীবিকার নিরাপত্তা নেই। যে সমাজে জীবন জীবিকার নিরাপত্তা থাকেনা সেই সমাজে মূল্যবোধ গড়ে উঠেনা। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতার বিকৃত বিকাশ ঘটে, যা সহযোগিতা ও সহমর্মিতা হীন আত্মস্বার্থে পর্যবসিত হয়।ফলে যুবকের যৌবনের ধর্ম বিসর্জিত হয় প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার শ্রমে। এবং তারপরও সে শেষ পর্যন্ত তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে
পারবে কিনা তা যেমন অনিশ্চিত থাকে, অন্যদিকে জাতিগত প্রত্যাশা যে মানুষ হওয়ার বাসনা,তাও হতাশায় নিমজ্জিত হয়।এই দায় কার? এই দায় লক্ষ্য উদ্দেশ্য পরিকল্পনা হীন একটি রাষ্ট্রের। যে রাষ্ট্র অর্ধশতকেও তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং গন্তব্য চূড়ান্ত করতে পারেনি। নাগরিকের অধিকার এবং সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। নিরাপদ জীবনের বিধান দিতে পারেনি। আর এসব অপারগতা আর ব্যর্থতা ঢাকার আপাত প্রচেষ্টা হিসাবে দৃশ্যমান হচ্ছে উড়াল সেতু,পদ্মা সেতু,মেট্রোরেলের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
কথা হচ্ছিল অনুভূতিতে আঘাত নিয়ে। এই যে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলেটি যৌবনের ধর্মে সাড়া না দিয়ে 'ছাত্রানং অধ্যয়ন তপ'তে সীমিত করেছে স্বপ্ন,আর একেই সংখ্যাগরিষ্ঠরা বাহবা দিচ্ছে। কেনো এর জন্য তাকে দোষ দেয়া যায় না, এর পেছনে সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায় কতো বেশি এই গুরুত্বপূর্ণ এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি নানা সম্ভাবনা নিয়ে ডালপালা মেলতে পারতো।
অথচ এই আলোচনা থামিয়ে দেয়া হলো অনুভূতি আঘাতের অজুহাতে।
অনুভূতিতে আঘাত সেই ইস্যু যার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই,ফলে যুক্তিহীন কারণে এই ইস্যু উসকে দেয়া যায়। উপরে বলেছিলাম এই অনুভূতিতে আঘাত আবার সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শীল নয়। সংখ্যালঘিষ্ঠ তার অনুভূতিতে আঘাত পেয়েছে বলে কোনো বিচার দিয়েছে বা পেয়েছে এমন নজির নেই। দুর্বল,ক্ষমতাহীন,চেয়ারহীন,সংঘবদ্ধ নয়(যাকে নেতিবাচক ভাবে সিন্ডিকেট বলা
যায়) এমন কেউ অনুভূতিতে আঘাত পেয়েছে বলে দাবি করেছে এমন উদাহরণও বিরল।
যে শব্দবন্ধ ক্রিয়াশীল কেবল সংখ্যাগুরুর শক্তি আর দম্ভের রক্ষাকবচ হিসাবে,যে শব্দবন্ধ খড়্গ হয়ে উঠে দুর্বল আর নিসঙ্গ মানুষের জন্য এখন সভ্য মানুষের বোধহয় উচিত এই শব্দটির যথার্থ সংজ্ঞা এবং করণীয় সংবিধিবদ্ধ করা। খুব দ্রুত।