1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অনুভূতিতে আঘাতের নামে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আর কতদিন

শামীমা নাসরিন
শামীমা নাসরিন
২৯ মার্চ ২০২৪

ইদানীং দুইটি শব্দ চারপাশে খুব বেশি শুনতে পাই- অনুভূতিতে আঘাত। সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে ধর্মীয় অনুভূতিতে। যার নামে সারা বিশ্বেই চলে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার।

https://p.dw.com/p/4eFOX
কুমিল্লায় কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভ
কুমিল্লায় ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় হিন্দু দেবতার মূর্তির পায়ের ওপর মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মন্দিরগুলোতে হামলা করে বিক্ষুব্ধ মুসলিমরা৷ পরে দেখা যায়, মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে কাজটি করেন৷ছবি: bdnews24.com

ধর্মীয় অনুভূতি ছাড়াও জাতিগত অনুভূতি, দেশীয় অনুভূতি, গণতান্ত্রিক অনুভূতি, লৈঙ্গিক অনুভূতিসহ আরো না জানি কত কত অনুভূতিতে আমাদের আঘাত লাগে। অনেক সবলের ঠুনকো অনুভূতি এমনকি ফুলের টোকাতেও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তখন সে তার পূর্ণ শক্তি দিয়ে ঝঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধ নিতে। আর তাতেই দেশে দেশে বেধে যায় দাঙ্গা। কাতারে কাতারে খুন হয় মানুষ, ভাঙা হয় উপাসনালয়, আগুনে পোড়ে লোকালয়, বাস্তুচ্যুত হয় অসংখ্য মানুষ।

এই যে অনুভূতি, এটা আসলে কী? কেনো বারে বারে সেখানে আঘাত লাগে। কেনো আমরা আহত হই, ক্ষুব্ধ হই কিংবা দুর্বল হলে বিষন্ন হই? কখনো ভেবে দেখেছেন কী।

অন্য একজনের কথা, কাজ বা আচরণ কোনো আমাকে আঘাত করে? আমিই বা কোনো অন্যকে জেনে বা না জেনে আঘাত করে ফেলি? চার বর্ণের ছোট্ট এই শব্দটি নিয়ে ভাবতে বসলে এমন হাজারো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায়।

আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব বলে নিজেদের দাবি করি। অথচ, মনুষ্যত্বের অনুভূতিই আমাদের মাঝে সবচেয়ে কম কাজ করে।

অনুভূতিতে আঘাত আর বুলিংয়ের শিকার-এই দুইটি বিষয়কে আমার কাছে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মনে হয়। যখন আমি সবলের দলে তখন কারো কথা-কাজ বা আচরণে আমার অনুভূতিতে আঘাত লাগে, আমি সংক্ষুব্ধ হই, প্রতিশোধ নেই। আর যখন আমি দুর্বলের দলে তখন সেই একই কথা-কাজ বা আচরণে আমি অপমানিত হই, বিষন্ন হই, বিপন্ন হই।

যে কারণে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রোজার মাসে অন্য ধর্মের লোকজনও দিনের বেলা প্রকাশ্যে খাবার খেতে ভয় পায়। যদি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়। আবার হিন্দু প্রধান দেশে গণহারে গো-মাংস নিষিদ্ধ হয়। আর সে নিষেধাজ্ঞার দোহাই দিয়ে কোনো মুসলিম পরিবারের ফ্রিজে গরুর মাংস থাকার ‘অপরাধে' সে বাড়ির লোকজনকে পিটিয়ে হত্যা করে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়।

আবার জাতগত অনুভূতিতে কিংবা মান-সম্মানের অনুভূতিতে আঘাত লাগে বলে কত পরিবার তাদের আদরের সন্তানকে হত্যা করতে পর্যন্ত পিছপা হয় না। যার গালভরা নাম ‘অনার কিলিং'।

এই যে আমাদের অনুভূতি, সেটাকে আমরা বড় ঠুনকো করে রাখি বলেই দুষ্ঠু লোকেরা, অসৎ লোকেরা, ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেটিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি দেখে আসছি বাংলাদেশে মাঝে মধ্যেই হিন্দু মন্দিরগুলোতে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোনআন পাওয়া যায়। আর তা নিয়ে ‘টনটনে অনুভূতির' একদল মুসলমান আঘাতপ্রাপ্তা হয়ে এলাকার হিন্দুদের মন্দির ভাঙে, বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে রীতিমত তাণ্ডব করে। অথচ, যাদের উপর হামলা চালিয়েছে ছোটবেলা থেকে তাদের সাথেই হয়তো হেসে-খেলে বড় হয়েছে। একসাথে কাজ করেছে, এক দোকানে বসে চা খেয়েছে, গল্প করেছে।

এমন ছোট-বড় ঘটনা প্রতি বছরই দেশের নানা প্রান্তে ঘটতে দেখা যায়। চুপিচুপি মন্দিরে কোরআন রেখে আসতে গিয়ে কিছু কিছু ‘কুটিল' মানুষ ধরাও পড়ে। যারা ধর্মের নামে ইচ্ছা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ জারি রাখতে চায়, যাতে তাদের ধর্ম ব্যবসা রমরমিয়ে চলে। এ সব খবর নিয়ে কাজ করতে গেলে আমার প্রথমেই যে ভাবনাটা আসে সেটা হলো, মানুষ কি করে এত বোকা হয়! আমরা তো এখন প্রযুক্তির সাহায্যে সব কিছু দ্রুত দেখতে পারি, জানতে পরি। বুঝতে পরি অসৎ উদ্দেশে অনেক ভুয়া খবর ছড়ানো হয়। আমরা সব জানি-বুঝি, তারপরও আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে আর আমরা মানুষ থেকে দানবে পরিণত হই।

একজন হিন্দু পুরোহিত কী তার জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য কোরআন পড়তে পারেন না? তাতে কী পাপ হয়? জ্ঞান অর্জন করার কথা তো সব ধর্মেই বলা আছে। তাহলে একজন পুরোহিত কোনআন পড়ে যদি তার জ্ঞান বাড়াতে চান তবে মন্দিরে কোরআন পাওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু না। ওটাই তো তার সবচেয়ে প্রিয় সবচেয়ে আপন স্থান। কেনো এই সাধারণ বিষয়গুলো আমাদের মাথায় ঢোকে না।

একই কথা প্রতিবেশী ভারতের বেলাতেও বলতে হয়। ভারত হিন্দু প্রধান দেশ। আর হিন্দু ধর্মে গো-হত্যা নিষিদ্ধ। আবার একই সঙ্গে এই কয়েক বছর আগেও বিশ্বের শীর্ষ গো-মাংস রপ্তানিকারক দেশ ছিল ভারত। এখন খুব সম্ভবত দ্বিতীয় নম্বরে। অথচ, গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র ট্রাকে করে গরু পরিবহন করার অপরাধে উগ্র হিন্দুদের দল হামলা চালিয়ে মুসলমানদের হতাহত করেছে। উত্তর প্রদেশসহ ভারতে কয়েকটি রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ

যা নিয়ে দেশটির অর্থনীতিবীদরা সতর্ক করে বলেছেন, গো-হত্যা নিষিদ্ধ হলে ভারতের রপ্তানি আয়ের একটি বড় খাত নষ্ট হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে গরু নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে সাধরণ কৃষকসহ সব মানুষকে। যেহেতু গো-হত্যা নিষিদ্ধ তখন কৃষকরা বাধ্য হয়ে বয়স্ক গরুগুলোকে রাস্তায় ছেড়ে দেবে। কারণ, সেগুলো আর তাদের কাজে লাগবে না। আর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো গরুগুলো ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের বাড়ি বাড়ি হামলা চালাবে। ভারতে কিন্তু এমন ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। কয়েক মাস আগে পথের ক্ষুধার্ত গরুর হামলায় একজনের মৃত্যুর খবর নিয়ে সংবাদও হয়েছে।

এভাবে নিজেদের অনুভূতি রক্ষা করতে গিয়ে আমরা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে পিছপা হই না। অথচ, প্রতিটি মানুষ আলাদা। তার পছন্দ-অপছন্দ আলাদা। আমার যেটা ভালো লাগে না সেটা অন্য কেউ করতে পারবে না, কেনো আমার বা আমাদের এমনটা মনে হয়।

এ প্রসঙ্গে আমার জীবনে অনুভূতিতে আঘাত লাগার একটা গল্প বলি। তখন আমার ছেলের বয়স দেড়-দুই বছর হবে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা রোগা ছিল। অসুখ লেগেই থাকতো। আর ওকে খাবার খাওয়াতে মাঝে মধ্যে খুব বেগ পেতে হতো। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে আমি কাজে যোগ দিয়েছিলাম। অসুস্থ ছেলে রেখে অফিসে যাই, নিজের মনের মধ্যে একধরণের অপরাধ বোধ কাজ করতো। সে সময় একদিন ছেলের জ্বর। কিছু খেতে চাচ্ছে না। খাবার খাওয়াতে ওকে নিয়ে আমার বাসার সামনের সরু গলিতে নেমে পড়ি। উদ্দেশ এটা-সেটা দেখে যদি একটু খাবার মুখে নেয়। ছেলে ছোট ছোট পায়ে হেলেদুলে হাঁটছে, আমি খিচুড়ির বাটি হাতে পেছন পেছন আছি। তখন রিকশা থেকে আমারই এক প্রতিবেশী ভাবি নামলেন। আমাকে দেখে বললেন, "কী ভাবি, খাবার নিয়ে একেবারে রাস্তায় নেমে গেছেন।” আমি বললাম, ছেলে খাচ্ছে না, কী করবো? উত্তরে উনি বললেন, "আপনার ছেলে যে শুকনা, অফিস করেন তো, ছেলের যত্ন ঠিক মত নিতে পারেন না।”

ওনার ওই কথায় সেদিন আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। রাগে-অপমানে প্রায় বছরখানে ওনার সঙ্গে কথা বলি নাই। এখন বুঝি, ওই যে নিজের ভেতরের অপরাধ বোধ। সেটাই আসলে আমার অনুভূতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তাই ভাবির সামান্য কথায় এত আঘাত পাই। অথচ, আমি কিন্তু জানি ওই ভাবি একটু সহজ-সরল। খুব ভেবে-চিন্তে তিনি কথা বলেন না। আমাকে সেদিন তিনি হয়তো কোনো কিছু না ভেবেই কথাটা বলেছেন।

আর কর্মজীবী মায়েরা তার সন্তানদের সময় একটু কম দিতে পারে। তাতে যত্নও হয়তো একটু কমই হয়ে যায়। তাতে কী বা এসে যায়? তা বলে তো মা হিসেবে সে পিছিয়ে থাকে না। সব মা ই সন্তানের জন্য তার সর্বোচ্চটা দিয়ে করে।

আমার ছেলের বয়স এখন ১০ বছর। অসুখ-বিসুখ স্বাভাবিকই হয়। ছোটবেলায় অনেক শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা দুর্বল থাকে, তাই তারা অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি রোগে ভোগে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসব বেশিরভাগ সময় ঠিক হয়ে যায়। যেমনটা আমার ছেলের বেলায় হয়েছে।

সহজ এই সত্যগুলো আমি এখন বুঝতে পারলেও ওই দিন ওই মুহূর্তে আমার মাথা কাজ করেনি। আমার বিচারবোধ লোপ পেয়েছিল। তাই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। এখন বুঝি, আমার নিজের ভেতরে থাকা অপরাধ বোধ সেদিন আসল কলকাঠিটা নেড়েছিল। যে কারণে আমার অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিল।

তাই অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে অন্য কারো উপর প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একবার ভেবে দেখবেন, নিজের ভেতরে থাকা কোনো অপরাধ বোধ এর পেছনে কাজ করছে নাতো।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য