1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘যেন আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি থাকতে পারবে না’

১৫ অক্টোবর ২০২১

কুমিল্লায় শুরু হয়ে দেশের অনেক জায়গায় মন্দিরে-মণ্ডপে হামলা হয়েছে৷ এমন হামলা আগেও হয়েছে অনেক৷

https://p.dw.com/p/41jjB
রানা দাশগুপ্ত
রানা দাশগুপ্তছবি: bdnews24.com

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত কথা বলেছেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা এবং রাষ্ট্র, প্রশাসন ও তার সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে৷

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে পুলিশ পাহারায় পূজা হয়৷ বিষয়টি আপনি কীভবে দেখেন?

রানা দাশগুপ্ত: আমাদের সরকারি দল, বিরোধী দলের নেতাদের কথার মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও একটি জায়গায় তারা একই সুরে কথা বলেন৷ সেটা হলো, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির৷ প্রশাসনের পাহারায়ই যদি সার্বজনীন পূজা করতে হয়, তাহলে তো প্রশ্ন জাগার কথা সম্প্রীতি আদৌ আছে কিনা৷

সম্প্রীতি আছে, নাকি নেই? আপনি কী মনে করেন?

আমার কথা হলো, পাকিস্তান আমলে যখন আমরা স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিলাম, তখন যে সম্প্রীতি ছিল আজকে সেই সম্প্রীতির জায়গাটা অনুপস্থিত৷

এর কারণ কী?

রাষ্ট্র যতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে, সংবিধানের যেহেতু সম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের যত অপব্যবহার করা হচ্ছে, তত বেশি সাম্প্রদায়িকতা তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ছে৷ সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু আছে, এটা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করছে৷

এই অবস্থা কতদিন ধরে?

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে সংবিধান সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলো৷ একই ধারায় এরশাদ বাঙালি সত্ত্বাকে বিভাজন করে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে সংযোজন করলেন৷ ১৯৯০ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠলো, তখন আন্দোলনকে বিপথে নিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনদিন ধরে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন চালানো হয়৷ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি যখন ক্ষমতায় এলো, তখন ২৭ দিন ধরে একটানা সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে৷ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত আমলেও প্রতিদিনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে৷ আমরা আশা করেছিলাম ২০০৮ সালের পর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না৷ কিন্তু ২০১১ সাল থেকে শুরু করে গতকালের ঘটনা পর্যন্ত আমরা লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন সময়ে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা জিকির তুলে বিভিন্ন সংখ্যালঘু পল্লিতে হামলা চালিয়েছে৷ শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ খ্রিস্টানের পল্লিতেও হামলা চালিয়েছে৷ ভাঙচুর করেছে৷ সর্বশেষ শারদীয় দুর্গাপুজোয় অষ্টমী ও নবমী এই দুই দিন টানা হামলা অব্যাহত রাখা হয়েছে৷

‘গত ১০ বছরে শতকরা দুই ভাগ হিন্দু বেড়েছে’

পরিসংখ্যান কী বলে? কত হামলা হয়েছে? কতগুলো মামলা হয়েছে৷ তার বিচারের কী অবস্থা?

২০০২ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে ১১টি খুনের ঘটনা ঘটেছিল৷ তিন দিনের বাচ্চা থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধকে পর্যন্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ আজও ওই পরিবার বিচার পায়নি৷ ২০০৮ সালে শাহাবুদ্দিন কমিশনের কাছে আমরা ১৫ হাজার ঘটনার তথ্য-উপাত্ত দিয়েছিলাম৷ কমিশন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ২০১১ সালের শেষের দিকে পাঁচ হাজার ঘটনার রিপোর্ট দেয় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে৷ সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত এই কমিশনের রিপোর্ট আলোর মুখই দেখলো না৷ বামু, উখিয়া, টেকনাফের ঘটনায় আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি৷ নাসিরনগরের ঘটনায় যারা চার্জশিটভুক্ত, তাদের চেয়ারম্যান প্রার্থী করা হয়েছে৷ চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণ হাট৷ ওখানে হারুন নামে একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান৷ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ৷ তার কাছে কিছু হেফাজতের নেতা গিয়েছিলেন সহযোগিতার জন্য৷ তখন তিনি হেফাজতের লোকজনকে বললেন, ‘‘আপনাদের বলতে হবে আপনারা প্রতিদিন কয়টা হিন্দুকে মুসলমান বানাবেন৷’’

এ পর্যন্ত কতগুলো মামলা হয়েছে? কোনোটির বিচার হয়েছে?

না, না, না৷ বিচার হয়নি৷

কোনো পরিসংখ্যান আছে?

কেবলমাত্র পূর্ণিমা রানী শীলের ঘটনা ছাড়া আর কোনো ঘটনার বিচার হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই৷ রামু, উখিয়া, টেকনাফের ঘটনায় ১৪টি মামলা হলো, আজও ১৩টির চার্জশিট দেয় হয়নি৷ নাসিরনগরেও একই অবস্থা৷ আগে তো মামলাই নেয়া হতো না৷ হামলাকারীদের জামিনে মুক্তি দেয়া হলো৷ ঝুমন দাসকে মুক্তি দেয়া হলো না৷ বলা হলো, জেলখানা তার জন্য নিরাপদ৷ ছয় মাস পরে মুক্তি দেয়া হলো৷ কিন্তু শর্ত দেয়া হলো, সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে হলে তাকে পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে৷

কুমিল্লার ঘটনায় কি পুলিশ ঠিক সময়ে গিয়েছিল? ব্যবস্থা নিয়েছিল?

না, ঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেয়নি৷

পুলিশ ঠিক সময় ব্যবস্থা নেয় না কেন?

আপনি পুলিশ প্রশাসন বাদ দেন৷ রাজনৈতিক দলের ভূমিকা কী? শুধু কি আমরা পুলিশের ওপর নির্ভর করবো? রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে জনগণ থাকে৷ তখন পুলিশ বেশি করে এনফোর্স করতে পারে৷ কিন্তু জনগণ যদি পাশে না থাকে, সেক্ষেত্রে পুলিশ তো অসহায়৷

এটা কি সব ক্ষেত্রেই?

প্রত্যেকটি ঘটনায়ই চিত্রটা এক৷ সরকার জিরো টলারেন্সের কথা বলেছিল কয়েকদিন আগে৷ কিন্তু কোথায় জিরো টলারেন্স? কুমিল্লার ঘটনায় তো জিরো টলারেন্স দেখা গেল না৷ এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না৷ এখন আমরা দেখতে চাই এটা কথার কথা না, আসলে বাস্তবায়িত হবে৷

বলা হয়, একদল হামলা করে আরেক দল রক্ষা করে৷ বাস্তব অবস্থা কী?

কোনো দল রক্ষা করে না৷

হামলার উদ্দেশ্য কী?

দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া৷ ১৯৪৭ সালে ২৯.৭ ভাগ ছিল হিন্দু৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দেখা গেল ২০ ভাগে নেমে গেছে৷ আর এখন বলা হচ্ছে সেটা আরো কমে শতকরা ১০ ভাগে নেমেছে৷ তাহলে আপনিই বলেন, শূন্য ভাগে আসতে আর কয় বছর বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে? একদিকে তাদের সহায় সম্পদ পাওয়া যায়৷ আরেক দিকে তারা বলে, বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্র৷ মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বলেছিল বাংলাদেশ ইসলমিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র৷ সেটাই হবে৷ পরাজিত শক্তি সেটাই করতে চায়৷

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কী কাজ? তারা কী করছে?

তারা তো আর সরকার না৷ তারা রাষ্ট্রও না, সরকারও না, প্রশাসনও না, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষও না৷ তাদের কাজ হলো প্রতিরোধের আহ্বান জানানো৷ মানুষের বিবেককে জাগ্রত করা৷ রাজনৈতিক দলের প্রতারণাকে উন্মোচিত করা৷ ঐক্যবদ্ধভাবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ, অধিকার রক্ষার চেষ্টা করা৷

সেটা কি তারা করতে পারছে? সফল হচ্ছে?

কিছুটা হয়েছে৷ অতীতে নিয়োগ, পদোন্নতিতে দেখেছি বৈষম্য৷ বৈষম্যের কিছুটা অবসান হয়েছে বলেই আমরা এখন যোগ্য সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন পদে দেখতে পাচ্ছি৷ আগে সংসদে মাত্র দুইজন প্রতিনিধি ছিলেন৷ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং সুধাংশু শেখর হালদার৷ এখন সংসদে ২৩ জন প্রতিনিধি৷ ইউনিয়ন পরিষদেও প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে৷ আগে কোনো ইউনিভার্সিটির ভিসি (সংখ্যালঘু) ছিল না৷ প্রশাসনে সহকারি সচিবের পর ডেপুটি সেক্রেটারি করা হতো না৷ এখন আমরা সচিব দেখছি৷

তাহলে আপনি সংখ্যালঘুদের নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন, আবার তাদের অবস্থার উন্নয়নের কথাও বলছেন, সেটা কীভাবে হয়?

এই সরকার সংখ্যালঘুদের স্বার্থ, অধিকার উন্নয়নে কাজ করছে বলেই বলা হচ্ছে গত ১০ বছরে শতকরা দুই ভাগ হিন্দু বেড়েছে৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালে পর থেকে দীর্ঘকাল যে শক্তিটি সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমিয়ে আনার পক্ষে ছিল, তারা রাষ্ট্র শক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ এখন তারা রাষ্ট্র শক্তির সাথে যুক্ত না থাকলেও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা আছে তো৷

ধর্মীয় অবমাননা এটা কি শুধু একটা ধর্মের? আপনাদের ধর্মের অবমাননা হলে কি আপনারা প্রতিকার পান?

না, না৷ আমাদের ধর্মের তো কোনো অবমাননা হয় না! কারণটা হলো আমাদের হাজার হাজার মন্দির যখন জ্বালিয়ে দেয়া হয়, তখন নাকি আমাদের বলতে হবে, আমরা সুখে আছি৷ অন্যদের ধর্মীয় অনুভূতি থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি থাকতে পারবে না- আজকের বাংলাদেশে সেই পরিস্থিতিই সৃষ্টি করা হচ্ছে৷