অপরিণামদর্শিতার মাশুল দেবেন মমতা?
২৭ নভেম্বর ২০১৪বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য৷ অভিযোগ করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এবং তিনি বলছেন, দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘র' অর্থাৎ ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং'-কে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকতে পারে! এমন সন্দেহ করার কারণ, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি নিজে ২৩ বছর কেন্দ্রে ছিলেন৷ কী ভাবে কী হয়, সব তাঁর জানা৷
কখন এমন গুরুতর অভিযোগ আনছেন মমতা? এমন এক সময়ে, যখন ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র এক দল বাংলাদেশে গিয়েছে বর্ধমানের বিস্ফোরণের সঙ্গে জঙ্গি যোগাযোগের তথ্য যাচাই করতে৷ যার পরেই বাংলাদেশ থেকে গোয়েন্দাদের এক দল ভারতে আসবে, তাঁদের হাতে থাকা তথ্য খতিয়ে দেখার জন্য৷
কেন এমন আন্তর্জাতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে? কারণ, দু’দেশের গোয়েন্দাদের কাছেই খবর, জামাত উল মুজাহিদ্দিন, বাংলাদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত কট্টরপন্থি গোষ্ঠী জেএমবি-র সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের এই বিস্ফোরণের যোগসূত্র আছে৷ পরের খবর আরও মারাত্মক৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার উপর হামলার একটা চক্রান্ত চলছিল দুই দেশে৷
এর পরই এমন এক বেপরোয়া মন্তব্য করে বসলেন এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, যা শুধু নিজের দেশকেই ছোট করে না, প্রতিবেশী বন্ধু দেশের শান্তি এবং সুরক্ষার গুরুত্বকেও পরোক্ষে খাটো করে! সবই আসলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যড়যন্ত্র, এমন অলীক অভিযোগ তুলে বরং নিজের অবস্থানকেই আরও নীচে নামালেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং এমন সন্দেহও হল যে, আসলে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থই তাঁর কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ, বাকি কিছু নয়৷
বলা বাহুল্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবজাত উষ্মা এবং আক্রোশ নিয়েই প্রকাশ্য সভায় এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছেন৷ প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এভাবে মেজাজ হারাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী? কারণ এক নয়, বরং একাধিক৷
একদিকে সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তে তাঁর দলের একের পর এক নেতা এবং সাংসদ ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-এর হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন অথবা জেরার চোটে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন৷ সারদার টাকা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে জামাতের হাতে চলে গেছে বলেও শোনা যাচ্ছে৷
অন্যদিকে বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের পিছনে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের ছায়া দেখা যাচ্ছে, যার জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে তো বটেই, নৈতিকতার বিচারেও প্রবল সমালোচিত হচ্ছে তাঁর সরকার৷ যেহেতু শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতায় আসতে এবং টিকে থাকতে, তাঁর দলই নাকি এতদিন স্রেফ নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে মদত দিয়েছে কট্টরপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে৷ এর দরুন হাত শক্ত হয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর৷
এর পালটা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মতো সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজ্যেও যে বিজেপির মতো এক হিন্দুত্ববাদী শক্তির ক্রমশ উত্থান ঘটছে, তার জন্য পরোক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসের ভ্রান্ত রাজনীতিকেই দায়ী করছেন অনেকে৷ পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও শঙ্কিত বিজেপির কাছে রাজনৈতিক জমি হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনায়৷
এর সঙ্গে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিজেদের ইচ্ছেমত চালিত করতে না পারা, অথবা চাহিদামত আর্থিক সাহায্যের প্যাকেজ না পাওয়া, রাজ্যের নিজের আর্থিক সঙ্গতিহীনতার ব্যর্থতা৷ তার পরেও বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সরকারি অনুষ্ঠানে বা নগর সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পে মাত্রাছাড়া খরচ করে সমালোচিত হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার৷
কাজেই তৃণমূল নেত্রী যে মেজাজ হারাচ্ছেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক৷ কিন্তু এসবের পিছনে কোথাও কি বিজেপির প্রত্যক্ষ চক্রান্তের হদিস পাওয়া যাচ্ছে, নাকি মনে হচ্ছে এ সবই তাঁদের নিজেদের অপরিণামদর্শীতার ফল?
সেই সহজ সরল সত্যিটা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয় বুঝতে পারছেন না, নয়ত বুঝেও মেনে নিতে পারছেন না৷ কিন্তু সেই হতাশার জায়গা থেকে তিনি যেভাবে পালটা আঘাত করার মরিয়া চেষ্টা করছেন, সেটাও মেনে নেওয়ার কোনো জায়গা নেই!