অপহরণের অলীক কুনাট্য
১৯ এপ্রিল ২০১৮২০ ফেব্রুয়ারি একটি বাংলা দৈনিকে মেটিয়াবুরুজে নাবালিকা অপহরণ বিষয়ক একটি খবর প্রকাশিত হয়৷ যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল — ৯ জুন, ২০১৭ কলকাতা পুরসভার সাফাই কর্মী বিনোদ দাসের নাবালিকা কন্যাকে অপহরণ করা হয়েছে৷ অপহরণকারীরা হলো মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানের বাসিন্দা মিন্টু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলি৷ গত আটমাস ধরে ক্ষমতাবান মিন্টু আলি এবং তার বাবা নাবালিকাকে তাদের ডেরায় আটক রেখেছে৷ নাবালিকার বাবা গার্ডেনরিচ থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন৷ কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ এবং অত্যন্ত নাটকীয় কায়দায় বোঝানোর চেষ্টা হয়, মেটিয়াবুরুজ এক মিনি পাকিস্তান, যেখানে ভারতের আইন চলে না৷
অভিযুক্ত অপহরণকারী মিন্টু আবার মেটিয়াবুরুজের ‘বাদশা'! তার এলাকায় ঢুকে তল্লাশি করার সাহস পুলিশেরও নেই৷ পুলিশ নাকি এ কথা আদালতে স্বীকারও করেছে৷ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণে নাবালিকার বাবা মেয়েকে ফিরে পেতে বাধ্য হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেন৷ হাইকোর্ট পুলিসকে নির্দেশ দেয়, অবিলম্বে ওই এলাকায় হানা দিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে৷ তখনই নাকি পুলিশ নিজেদের অক্ষমতার কথা জানায়৷
খবরটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ভাইরাল হয়ে হয়ে যায়৷ পত্রিকার ওয়েবসাইট থেকে দশ হাজারেরও বেশি শেয়ার হয়৷ এরপর সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ পুলিশ প্রশাসন, মেটিয়াবুরুজ এলাকা ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করে৷ তাদের দাবি, মুসলিম অধ্যুষিত বলেই পুলিশ মেটিয়াবুরুজে মিন্টু আলির ডেরায় হানা দিচ্ছে না৷ কয়েকদিন ব্যাপক প্রচারের পর খবরটি থিতিয়ে যায়৷
প্রায় দেড়মাস পর, ১২ এপ্রিল আরেকটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক এনিয়ে আবার খবর করে৷ সোশ্যাল মিডিয়া ফের সরগরম হয়৷ অনেকেই মেটিয়াবুরুজের মুসলিম মহল্লা থেকে ওই নাবালিকাকে উদ্ধার, মিন্টু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলির গ্রেপ্তারের দাবিতে পথে নামার ডাক দেন৷ এবং ক্রমশ রং চড়তে থাকে বয়ানের৷ বলা হয়, আট মাস ধরে নাবালিকা মেয়েটিকে মুসলিমরা আটকে রেখে গণধর্ষণ করছে৷ তাকে উদ্ধারে সমস্ত হিন্দুদের অস্ত্র হাতে পথে নামার ডাক থেকে শুরু করে মেটিয়াবুরুজ এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের সেনা অভিযানের মতো হাস্যকর দাবিও তোলা হয়৷ ওদিকে বিজেপির নেতা ও সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়ায়, মোবাইল মেসেজে বলে বেড়াতে থাকেন, কাশ্মীরের কাঠুয়ার ধর্ষিতা শিশুকন্যা, বা উন্নাওয়ের ধর্ষিতার জন্যে যাদের প্রাণ কাঁদছে, তারা কেন একজন হিন্দু মেয়ের এহেন সর্বনাশে চুপ করে আছে?
এভাবে যখন লাগাতার লোক খেপানো চলছে, কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) একটি টুইট বার্তায় সতর্ক করেন — সোশ্যাল মিডিয়ায় এক মিথ্যে গুজবের প্রচার চলছে যে এক নিখোঁজ নাবালিকাকে মেটিয়াবুরুজের একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে এবং পুলিশ সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছে৷ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে এই গুজবে বিশ্বাস করবেন না৷ যাঁরা গুজব ছড়াবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
প্রায় একই সঙ্গে নাগরিক উদ্যোগে একটি তথ্য অনুসন্ধান কমিটি মেটিয়াবুরুজে যায়, অপহরণ মামলার কাগজপত্র, এ সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশের কপি, সাক্ষীদের বয়ান খতিয়ে দেখে সোশ্যাল মিডিয়াতেই জানায়, পুরোটাই মিথ্যার বেসাতি, এবং ঘোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ ওই অনুসন্ধান কমিটির নেতা মহম্মদ জিম নওয়াজ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে জানালেন, অভিযোগের বয়ান এবং বাস্তবের মধ্যে বিস্তর গরমিল৷ যেমন কলকাতা পুলিশ মেয়েটির খোঁজে মেটিয়াবুরুজে যাওয়ার ‘সাহস পায়নি', এ দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যে৷ হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশের আগে এবং পরে গার্ডেনরিচ থানা, রাজাবাগান থানা এবং লালবাজার থানা থেকে প্রায় ২০ বার পুলিশ মিন্টু আলির বাড়িতে এসেছে, রেড করেছে এবং পরিবারের সদস্যদের জেরা করেছে৷ নাবালিকার বাবাকেও সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে এসেছে৷ আদালতের নির্দেশের আগেই রাজাবাগান এবং গার্ডেনরিচ থানায় একাধিকবার মিন্টুকে ডাকা হয়েছে৷ ধরে আনতে হয়নি, পরিবারের সদস্যরা মিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে থানায় এবং লালবাজারে পুলিশ সদরে একাধিকবার হাজিরা দিয়েছে৷ মিন্টুকে সাথে নিয়ে পরিবারের লোকজন সেখানেও গেছেন৷ বেশিরভাগ সময়ই নাবালিকার বাবা বিনোদ দাসও উপস্থিত থাকতেন৷
মিন্টু আলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে মেটিয়াবুরুজের ‘বাদশা'৷ এলাকায় বিশাল প্রভাব তার এবং তার বাবা কোরবান আলির৷ ২১ বছর বয়সি সোভান আলি, ওরফে মিন্টু আলি আদতে পেশায় একজন দরজি৷ আর তার ৫৫ বছরের বাবা কোরবান আলি পেশায় ছিলেন ভ্যানরিকশ চালক৷ ২০১৬ সালে তাঁর প্রথমে যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে, এবং পরের বছর লিভারে ক্যানসার৷ মিন্টু তার বাবা, মা, এবং ছোট বোনকে নিয়ে থাকে ১০ ফুট বাই ৮ ফুট একটি ঘরে৷ এরাই নাকি ভয়ংকর সমাজবিরোধী এবং প্রভাবশালী! মহম্মদ জিম নওয়াজ ডয়চে ভেলেকে জানাচ্ছেন, বিনোদ দাস তাঁর নাবালিকা কন্যার অপহরণের রিপোর্টে প্রথমে মিন্টু বা তার বাবার নাম দেননি৷ বলেছিলেন, স্কুলে যাওয়ার পথে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, নাবালিকা হলে নিখোঁজের ক্ষেত্রেও অপহরণের মামলাই দায়ের করতে হবে৷ তিন মাস পরে সেই অপহরণের মামলায় জুড়ে যায় মিন্টু, তার বাবা ও আরও কিছু দুষ্কৃতির নাম৷ অভিযোগের বয়ান বদলে হয়ে যায়, বিনোদ দাসের বাড়ির দরজা থেকে মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ওরা৷ কারণ ততদিনে একজন আইনজীবী এসে মামলায় যোগ দিয়েছেন, যিনি বিজেপি যুব মোর্চার স্বঘোষিত নেতা এবং একবার পদ্মফুল চিহ্নে নির্বাচনও লড়েছেন৷ আর গোটা বিষয়টির প্রচারের দায়িত্ব নেয় হিন্দু একতা মঞ্চ, যারা কিছুদিন আগেই কাঠুয়ার শিশুকন্যার ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করেছে!
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷