অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকেই সংগ্রাম চালান শ্যামলী
২৮ মে ২০১১১৯৪২ সালের ২২ এপ্রিল তৎকালীন ময়মনসিংহের অন্তর্গত শেরপুরে জন্ম শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর৷ বাবা দেবেন্দচন্দ্র দেব এবং মা স্মৃতিকণা দেব৷ স্বামী চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্যামলীর বয়স ছিল ২৯ বছর৷ ঢাকার পুরনো পল্টনে থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন শ্যামলীর পুরো পরিবার৷ দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে হলে সবাই দেশ ছেড়ে ভারত চলে গেলে চলবে না৷ বরং দেশের মধ্যে থেকেই নানাভাবে এই লড়াইকে এগিয়ে নিতে হবে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ডা. চৌধুরী এবং শ্যামলীর পরিবার ঢাকায় অবস্থান করে যুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন৷
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর সময় থেকেই কবি, সাহিত্যিক, নেতা, কর্মীসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন৷ আবার প্রয়োজন ও সুযোগ বুঝে নানা ছদ্মবেশে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছেন৷ এমনকি স্বয়ং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ২৫ মার্চ রাত থেকে তাদের বাসায় লুকিয়ে রাখেন৷ এরপর ২৮ মার্চ সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে তাঁকে বোরখা পরিয়ে মেয়ে মানুষের ছদ্মবেশে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন৷
অবরুদ্ধ ঢাকায় অবস্থান করে গোপনে বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা তুলে এবং অর্থ সংগ্রহ করে তা মুক্তিযুদ্ধের কাজে লাগাতেন শ্যামলী৷ এমনকি চাল-ডাল, ওষুধ সংগ্রহ করতেন তাঁরা৷ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে যেতো৷ আবার অনেক সময় বিভিন্ন কারখানা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা৷ এরপর শীত চলে আসলে মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের জন্য নিজ হাতে জাম্পার বুনতেন শ্যামলী এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা৷ তাদের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে এসব শীতের কাপড় নিয়ে যেতেন৷
শ্যামলী এবং তাঁর স্বামীর এসব গোপন তৎপরতার খবর শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের কাছে অজানা ছিল না৷ তাই ১৫ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের দিন বিকেল সাড়ে চারটায় অস্ত্রের মুখে তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদাররা৷ বধ্যভূমিতে নিয়ে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে ডা. আলীম চৌধুরীকে হত্যা করা হয়৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দিন পর তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়৷ মুক্তিযুদ্ধের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নিজেদের কর্মতৎপরতার কথা ডয়চে ভেলের কাছে তুলে ধরেন শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী৷ এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছোবলে স্বামী হারানোর কাহিনী জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শ্যামলী৷
তবুও দেশমাতৃকার মুক্তিই সবচেয়ে বড় অর্জন এবং পাওয়া বলে নিজেদের ত্যাগের সার্থকতা খোঁজেন শ্যামলীর মতো বীর সাহসী নারীরা৷ কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছর পার হতে চলেছে অথচ এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে শ্যামলীর হৃদয়ের গভীরে৷ ডয়চে ভেলের সাথে টেলিফোন সংলাপে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রিয় দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে সেটিই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন৷ তবে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনও হয়নি৷ এতোদিন পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় থেকেছে তারা কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করল না? শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সরকার এবং শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার চেষ্টা করেছে৷ এছাড়া এতো কষ্টের এবং ত্যাগের বিনিময়ে এই দেশটিকে স্বাধীন করলাম অথচ এখন পর্যন্ত জাতির প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কেন স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত নেই সেজন্য খুব আফসোস হয়৷ তাই গোটা জাতির মাঝে সেই চেতনা জাগিয়ে তুলতে এবং প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে আমরা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি৷ এই লড়াইয়েও আমরা সফল হবো সেটিই আমাদের প্রত্যাশা৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক