1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বাণিজ্যবাংলাদেশ

অর্থনীতির ক্ষত সারাতে সুসময়ের অপেক্ষা

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৭ মে ২০২৪

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপের মুখে আছে৷ ডলারের সংকট কাটছে না৷ প্রতিনিয়তই কমছে রিজার্ভ৷ চাপ কমাতে ইউয়ানে চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছে সরকার৷

https://p.dw.com/p/4g0PN
চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রেনের সাহায্যে কন্টেইনার ওঠা-নামার চিত্র
আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও প্রতি বাংলাদেশে প্রতি মাসে আমদানি দায় মেটানোর জন্য গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছেছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images

দায়হীন রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কিছুটা কম৷ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের কাছ থেকে এই ধরনের ঋন সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংকটের সমাধান হবে না৷ কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষত অনেক গভীরে, খুব সহসাই এই ক্ষত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক, তবে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি৷

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) মার্চ ও এপ্রিল মাসের দায় মেটানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মোট রিজার্ভ কমে ২৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে৷ আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার৷ তবে প্রকৃত বা দায়হীন রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কিছুটা কম৷

রিজার্ভ সংকট কাটাতে চীনের কাছ থেকে ইউয়ানে ঋন নিলে স্বস্তি মিলবে কীনা জানতে চাইলে বানিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি মনে করি চীনের এই ঋণ আমাদের বিশাল স্বস্তি দেবে, এটা ট্রেড ফাইন্যান্সিং৷ আমাদের ডলারের চাহিদা দুই কাজে: একটা হল, আমরা খাদ্য আমদানি করে খেয়ে ফেলি৷ সেখানে কিছু ডলার যায়৷ আরেকটা হল রি-এক্সপোর্টের জন্য৷ এটাই হল ট্রেড ফাইন্যান্সিং৷ আমাদের যে তিন মাস, ছয় মাসের জন্য ডলারটা আটকা থাকে, সেখানে কিন্তু আমরা ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় পাব৷ এই সময় আমার ডলারটা লাগবে না৷ এরপর যখন ডলার আসবে, তখন আমরা পেমেন্ট করব৷ আমি একটা সহজ উদাহরণ দেই, আপনি একটা মুদি দোকান করেছেন, সেখান যদি আপনি সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পান তাহলে আপনার আর টাকা লাগে না৷ ও জিনিস দিয়ে গেল, আপনি বিক্রি করে টাকা ফেরত দিলেন, এজন্য অনেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেয়৷ এটাও এক ধরনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট৷ মূলত কাঁচামাল আমদানি করতে আপনার ৬০ দিন থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে৷ এই সময়টা আপনার কোন ডলার আটকা থাকবে না৷ বরং যে ডলার আসবে সেটা দিয়েই আপনি পেমেন্ট দিতে পারবেন৷ ফলে যে যে দৃষ্টিকোণ দিয়েই দেখুক, আমি যদি দুইটা মাস বাফার তৈরি করতে পারি তাহলে এখন অর্থনীতি যে ধরনের চাপে আছে সেটা আর থাকবে না৷ আমার এখন এই সাইকেলটা ঘুরানো দরকার৷ এই ঘুরানোর জন্য চীনের ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণটা আমাদের অনেক বেশি কাজে দেবে৷’’

চীনের এই ঋন আমাদের বিশাল স্বস্তি দেবে: আহসানুল ইসলাম টিটু

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এখন আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও প্রতি মাসে আমদানি দায় মেটানোর জন্য গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে৷ ফলে প্রকৃত রিজার্ভের অর্থ দিয়ে তিন মাসেরও আমদানি খরচ মেটানো যাবে না৷ অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আশংকাজনক পর্যায়ে নেমেছে৷ জানা গেছে, গত সপ্তাহে আকু বিল বাবদ রিজার্ভ থেকে ১৬৩ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়, ফলে রিজার্ভ আরও কমে যায়৷ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেয়া নিট বা প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ১১ কোটি মার্কিন ডলার৷ বাংলাদেশের অনুরোধের পর আইএমএফ এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলারে নামিয়েছে৷

এই পরিস্থিতিতে রিজার্ভ কিভাবে স্থিতিশীল হতে পারে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ধরনের ঋণ হল স্বল্পমেয়াদি সমাধান৷ রিজার্ভকে স্থিতিশীল করার জন্য বা অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদি এটা কোন সমাধান না৷ এই ধরনের ঋণ সাময়িক সময়ের জন্য স্বস্তি দিতে পারে৷ কয়েক মাস পরে কিন্তু আবার একই ধরনের সংকটে পড়তে হবে৷ রিজার্ভের এই সংকটে পদক্ষেপ কিছু কিছু নেয়া হচ্ছে৷ এখন ধরেন ডলার এক্সচেঞ্জ রেটটা পরিবর্তন করা হয়েছে, সুদহার বাড়ানো হয়েছে৷ এই সব জায়গায় কিছু সংস্কার করা হচ্ছে৷ এই বিষয়গুলোকে আমি ইতিবাচক দিক হিসেবেই দেখছি, এগুলো ঠিকই আছে৷ এগুলো বরং অনেক আগে নেওয়া উচিৎ ছিল৷ কিন্তু আমরা রিজার্ভ নিয়ে যে সংকটে আছি, সেটা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি৷ অনেকদিনের পুঞ্জিভূত সংকট৷ আমাদের রিজার্ভের সংকট কাটাতে হলে ‘ডলারের ফ্লো' বাড়াতে হবে৷ বিদেশ থেকে যে ডলার আসছে, সেখানে হুন্ডি কিন্তু একটা বিরাট সমস্যা৷ একজন শ্রমিক যিনি বিদেশ থেকে ডলার পাঠাচ্ছেন, তিনি কিন্তু যেখানে বেশি দাম পাবেন, সেখানেই যাবেন৷ পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে৷ সেটা তো আর একদিনে হবে না৷ এজন্য সময় লাগবে৷ বিশেষ করে পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে৷’’

বাংলাদেশের জন্য পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস এখন চীন৷ ডলার সংকট মোকাবিলা এবং ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠেকাতে ইউয়ানে দেওয়া চীনের ঋণ বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন৷ চীন চাইছে ইউয়ানে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ বাণিজ্য সহায়তা (ট্রেড ফ্যাসিলিটি) হিসেবে দিতে৷ চীনা মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ইউয়ানের বেশি৷ তবে এ ধরনের ঋণের শর্ত সাধারণত কঠিন হওয়ায় বাংলাদেশ বাণিজ্য সহায়তার পরিবর্তে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে আগ্রহী৷ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনের আগ্রহের বিষয়টি নিয়ে এখন বিশ্লেষণ চলছে৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চীনের এই ঋণ আমাদের রিজার্ভকে যে বুস্টআপ করবে আমার তেমনটা মনে হয় না৷ তবে আমাদের চীনের সঙ্গে বিরাট বাণিজ্য আছে৷ সেখানে বাণিজ্য ঘাটতিও আছে৷ এখন আমরা চীনের যে বিল সেটা ইউয়েন দিয়ে শোধ করতে পারব৷ তবে সেখানে কিন্তু চুক্তিতে বিষয়গুলো পরিষ্কার উল্লেখ থাকতে হবে৷ তাদের সঙ্গে আমাদের যে ট্রেড ফাইন্যান্সিং, সেগুলো আমরা ইউয়েন দিয়ে শোধ করব, এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে৷ তবে সার্বিক অর্থনীতিতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দ্বিপাক্ষিক এই ধরনের ঋণে সময় খুব কম থাকে, সুদের হার বেশি হয়৷ আমাদের কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে৷ তার সঙ্গে এটা যুক্ত হলে চাপ উল্টো বেড়ে যেতে পারে৷ এগুলো শোধ করা আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে, দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে৷’’

এই ধরনের ঋন সময়িক সময়ের জন্য স্বস্তি দিতে পারে: ড. সায়মা হক

গত মার্চেই বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে গেছে৷ এখন ডলারের দাম বেড়ে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় সুদ ও আসল পরিশোধে আগের চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করতে হবে৷ নতুন নীতির কারণে ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ টাকা থেকে ১১৭ টাকা হয়েছে৷ আর খোলা বাজারে ১১৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে৷ ফলে ডলার প্রতি ঋণের খরচ এক দিনেই সাত টাকা বেড়ে গেল৷ বিদেশি ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধ করতে চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে৷ ডলারের হিসাবে যা ৪৮ শতাংশ বেশি৷ ডলারের দাম নতুন করে আরেক দফা বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ তৈরি হলো৷ শুধু মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণেই সমপরিমাণ সুদাসল পরিশোধে বেশি টাকা দরকার হবে৷

ঋণ করে ঋণের সুদ পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোন ঋণ নিয়ে সংকটের সমাধান হয় না৷ সাময়িক সময়ে হয়ত কিছুটা উত্তরণ ঘটতে পারে৷ স্থায়ী সমাধানের জন্য পলিসি দরকার৷ এখন যে পলিসি নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আমার কাছে ভালোই মনে হচ্ছে, এবিদেশি ঋণগুলো অনেক আগে নেয়া দরকার ছিল৷ এটার ‘ইমপ্যাক্ট' দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ এখন আমরা ইউয়ানে ঋণ নিলেও কিন্তু ডলারে শোধ করতে হবে৷ কারণ আমাদের কাছে তো ইউয়ানে নেই৷ ফলে ইউয়ানে দিতে হলোও ডলার বিক্রি করে ইউয়ান কিনে ঋণের কিস্তি দিতে হবে৷ অতত্রব সাময়িক কিছু সুবিধা হলে স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদের আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে৷’’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এখন দেড় লাখ টাকা৷ মাত্র তিন বছর আগে মাথাপিছু ঋণ ছিলো এক লাখ টাকা৷ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপির তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে৷ প্রতিবছরই এই অনুপাত বেড়েছে৷ সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮ শতাংশে৷ এই অনুপাত এখনো খারাপ অবস্থায় না গেলেও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার ওপর পরিস্থিতি নির্ভর করে৷ সিপিডির তথ্য বলছে, গত অর্থবছর শেষে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিন গুণ বেড়েছে৷ অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে৷ শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে৷ এমন অবস্থায় সরকার চলতি অর্থবছরেই দাতাদের কাছ থেকে আরো এক হাজার কোটি ডলার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে৷

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রিজার্ভ সংকট কাটাতে এখন যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে, এগুলো আরও ৪-৫ বছর আগেই নেয়া দরকার ছিল, এগুলো আপাতত ভালোই মনে হচ্ছে৷ তবে আমাদের অর্থনীতির ক্ষত অনেক গভীরে৷ এই ক্ষত কাটাতে এই ধরনের পদক্ষেপের সঙ্গে সুশাসন ও জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন৷ পাশপাশি অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে হবে, দুর্নীতি কমাতে হবে৷ এখন সরকার যে কাজগুলো করছে, এর সঙ্গে এই কাজগুলোও করতে হবে৷ এই কাজগুলো যত দ্রুত করা যাবে, আমাদের অর্থনীতির ক্ষত দ্রুত কমে আসবে৷ আগামী দুই তিন বছরও লেগে যেতে পারে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে৷ তারপরও ইউয়ানে যে ঋণ সরকার নিতে যাচ্ছে, এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে৷ এই স্বস্তির মধ্যেই বাকি কাজগুলো করে যেতে হবে৷ এখানে অবহেলা করলে সংকট কাটবে না৷’’