৮ আগস্ট রাতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়৷
এই সরকার এখন দেশকে একটি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে তাদের সামনে থাকা অনেকগুলো দুরূহ কাজের মধ্য থেকে৷ এর মধ্যে অর্থনীতির গতি ফেরানোটা অন্যতম দুরূহ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ৷
বস্তুত বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ হাসিনা সরকারের অপশাসন, লুটপাট ও মিথ্যাচারের ফলে দেশের ব্যাংকগুলো, তথা আর্থিকখাত ভীষণ নাজুক হয়ে পড়েছে; অব্যাহত চড়া মূল্যস্ফীতি জীবনযাত্রা অত্যন্ত ব্যয়বহুল করে তুলেছে; এবং বেপরোয়াভাবে নেয়া ব্যয়বহুল বিদেশি ঋণের বোঝা ঘাড়ে চেপে বসেছে৷ এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালে কল-কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু শিল্প-কারখানা ও দোকানপাট আক্রান্ত ও বিনষ্ট হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব ৷ এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকখাতের অবনতি ঠেকানোকে দু'টি প্রথম প্রধান করণীয় হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোতেও ক্রমশ তাদের মনোযোগ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে৷ কেননা, অর্থনীতির একটি ক্ষেত্র আরেকটির সাথে সম্পৃক্ত৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেব অনুসারে, চলতি বছর জুলাই মাসে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৯০ শতাংশ৷ আর এই মাসে এসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে৷ জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ৷ এক মাসের ব্যবধানে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে৷ জুলাইয়ে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে, তা গত ১৩ বছর ৪ মাস বা ১৬০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ এর আগে সর্বশেষ সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে, ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ৷ এরপর আর কখনো খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশে ওঠেনি৷
সামষ্টিক অর্থনীতির অব্যবস্থাপনাজনিত পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় দেশে উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, যা এখনো চলমান৷ হাসিনা সরকার ক্ষমতার শেষ কয়েক মাসে নির্বিচারে টাকা ছাপিয়ে ঋণ গ্রহণ করায় বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে রাখে৷ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৯৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশই সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বা টাকা ছাপিয়ে৷ আবার ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে পণ্য সরবরাহ-ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় খুচরা বাজারে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়৷ তথ্য-উপাত্তের গোলমাল ও কারসাজির কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার প্রকৃত উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদার প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট না থাকায় মধ্যে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীনতা বজায় থেকে মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিভাবে মূল্যস্ফীতিকে কয়েকমাসের মধ্যে উপদেষ্টাদের প্রত্যাশা অনুসারে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হবে, তা দেখার বিষয়৷
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হতে শুরু করলে, যা হবে তা হলো: মূল্যস্ফীতির গতি কমবে বা ভোক্তা মূল্য লাফিয়ে বাড়বে না, বাড়বে ধীর গতিতে৷ এতে করে ভোক্তারা বাজারে বেশিরভাগ পণ্যই আর দু-এক বছর আগে যে দামে কিনতে পেরেছিলেন, তা পাবেন না৷ তাঁরা হয়ত ছয় থেকে নয় মাস আগে যে দাম দিয়েছিলেন, তার চেয়ে কিছুটা কম দামে কিনতে পারবেন৷ আর কিছু পণ্যের দাম অপরিবর্তিতই থাকবে৷
দেশের ব্যাংকখাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বোঝা গোটা আর্থিক খাতকেই ভীষণভাবে নাজুক করে দিয়েছে৷ চলতি বছরে মার্চ মাসের শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ব্যাংক ঋণের ১১ শতাংশ৷ অন্যদিকে ২০০৮-২০২৩ সময়কালে দেশে ব্যাংকখাতে দু'ডজন কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়৷ এই পরিমাণ টাকা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির (২০২২-২৩ অর্থবছর) দুই শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশ৷
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম মেয়াদেই দেশের সবচেয়ে ভালো একটি ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের সর্বনাশ ঘটায় সরকারদলীয় চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর মাধ্যমে৷ তিনি একাই দেড় বছরের মধ্যে সাড়ে চার হাজার কোটি নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলেন নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে৷ এই সময়কালে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গোষ্ঠী অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে৷ এভাবে বছরের পর বছর ছোট-বড় নানা অনিয়মের মাধ্যমে চলতে থাকে লুটপাট আর তৈরি করা হয় স্বজনতোষী গোষ্ঠী৷ বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি লুটপাটের কিছু উপায়কে বৈধতাও দেয় নিয়ম-কানুন পাল্টে ও শিথিল করে৷ এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের দৌরাত্ম এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, গণমাধ্যমেও কিছু সংবাদ প্রকাশ হওয়া ছাড়া কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেয়া যায়নি৷ আবার ২০১৭ সালে জামাত-শিবিরমুক্ত করার নামে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা-পর্ষদ পাল্টে ফেলা হয় জবরদস্তিমূলকভাবে, কোনো নিয়ম-কানুনেরর তোয়াক্কা না করে৷ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রপের দখলে দেয়া হয় দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ও সফলতম বাণিজ্যিক ব্যাংকটিকে৷ পাশাপাশি আরো কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা প্রায় এককভাবে এই শিল্পগোষ্ঠীর কাছে তুলে দেয়া হয় রাজনৈতিক মদদে৷ ছয় বছরের মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে এই গোষ্ঠী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো৷ এর অনেকটাই নানা অনিয়ম ঘটিয়ে নেয়ায় বড় অংশই ফেরত না আসার আশঙ্কা রয়েছে৷ মাঝখান থেকে ব্যাংকটিকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে৷ আরো পাঁচ ব্যাংকে এই শিল্পগোষ্ঠীর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে৷
বস্তুত বাংলাদেশের গোটা ব্যাংক খাত এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে করে এতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং খেলাপি ঋণ আদায় করে ব্যাংকগুলোকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবসা করতে দেয়ার ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্যই বটে৷ সরকার অবশ্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করে এই খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচর্নার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এই কমিশন ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনাও দেবে৷
আবার দেশি-বিদেশি ঋণের বিপুল বোঝাও একটি বিরাট দায় হয়ে রয়েছে৷ বিশেষত বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আগামী দিনে আরো বাড়বে৷ হাসিনা সরকারের নেয়া বিদেশের ঋণের স্থিতি এখন প্রায় সাত হাজার কোটি ডলার, যা আগামী দিনে বিভিন্ন মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে, কোনোটি দ্রুত আর কোনোটি একটু দেরিতে৷ যেমন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালের৷ তবে এ সময় আরো দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য রাশিয়ার সাথে দেন-দরবার চলছে৷
বিদেশি ঋণ যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রায়, তথা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হয়, সেহেতেু রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়৷ রপ্তানি আয়ে শ্লথগতির বিপরীতে প্রকৃত আয়কে কারসাজি করে ফুলিয়ে দেখানোর ফলে লেনদেনের ভারসাম্যের হিসাবে বড় ধরনের গোলমাল সম্প্রতি ধরা পড়েছে৷ প্রকৃত রপ্তানি আয় কম হওয়ায় তা কাগজে-কলমে লুকানো রাখা গেলেও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যায়নি৷ আবার রিজার্ভও অনেক বছর ধরে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল৷ ফলে, অর্থনীতির চিত্র অনেকটাই বিকৃত আকারে সামনে এসেছে, যার ওপর ভিত্তি করে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সমস্যা বাড়িয়েছে বৈ কমায়নি৷
সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে একটা স্বাভাবিক গতিময়তা ফিরিয়ে আনার যে দুরূহতর মিশনে নামতে হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে, তাতে কতটা সাফল্য আসবে, সেটা সময় বলে দেবে৷ আপাতত বেশ কিছুদিন ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই৷