অ্যামেরিকান প্রফেসরের কবিরাজি
১৫ নভেম্বর ২০১৯আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক তিনি৷ অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ করছি না৷ অ্যামেরিকান পঞ্চাশোর্ধ এ শিক্ষকের পাণ্ডিত্য কালচারাল ও মেডিক্যাল এনথ্রোপলজি নিয়ে৷ আর তাঁর প্রবল আগ্রহ রিচুয়াল হিলিং বিষয়ে৷ দীর্ঘ বছর ধরেই তিনি এ বিষয়ে একাডেমিক গবেষণায় নিয়োজিত আছেন৷
ইসলাম ধর্মে কোন ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থাকে কিভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটিই ছিল এ কোর্সটির মূল আলোচনার জায়গা৷ আর তাই মরক্কো থেকে আফগানিস্তান কিংবা বাংলাদেশ থেকে ইরান প্রায় সব দেশেই কীভাবে সামাজিক পরিবেশের সাথে ধর্মীয় চিকিৎসা জড়িয়ে আছে সে বিষয়ে আলোচনা চলতো ক্লাসে৷
নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমার এ প্রফেসর এথনোগ্রাফিক গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন৷ বিভিন্ন সময়ে নবী মোহfম্মদের (স.) দেওয়া ওষধি গাছ ও ভেষজ ফল দিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়াতেন তিনি৷
ইসলামি চিকিৎসাবিদেরা জিনের আস্তিত্বকে খুব গুরুত্ব নিয়েই দেখে থাকেন৷ মেডিক্যাল অ্যান্থ্যপলোজিতেও তাই এ বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের৷ বিজ্ঞ ওই প্রফেসরও বাংলাদেশ, পাকিস্তান ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসাকে গুরুত্ব দিয়েই প্রতিষ্ঠানিক আলোচনার অংশ করে নিয়েছেন৷ এমনকি সিলেটের শাহজালালের মাজারের উৎপত্তি ও এর বর্তমান চর্চা নিয়েও রয়েছে তাঁর ব্যাপক জানাশোনা৷
একদিন ক্লাসে নিজের গবেষক দলের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি৷ বলছিলেন দিল্লির এক মাজারের কথা৷ এ মাজারের খাদেমের বেশ কিছু বন্ধু জ্বীন রয়েছে৷ আমার প্রফেসরের এক সহকর্মী গবেষণার কাজে সেই মাজারের খাদেমের সাথে দেখা করতে যান৷ কথা বলছিলেন দুজন৷ আলোচনার ফাঁকে ইয়া লম্বা এক ভদ্রলোকের প্রবেশ৷ উপস্থিত খাদেমকে আগত ভদ্রলোক বললেন ‘‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম৷ ভাবলাম দেখা করে যাই৷'' কুশল বিনিময়ের পর চলে গেলেন আগত ভদ্রলোক৷
খাদেম তখন সেখানে উপস্থিত গবেষককে জানালেন আগত এ ভদ্রলোক আদতে মানুষ নন, মানুষের বেশে দেখা করতে এসেছেন৷
তাকালাম আমার প্রিয় শিক্ষকের মুখের দিকে৷ এসব বিশ্বাস করেন কিনা জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি৷ কেননা, একটি প্রশ্ন তাঁর কয়েক দশক ধরে করা গবেষণার প্রয়োজনীয়তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে৷
পণ্ডিতমশাই বুঝতে পারলেন আমার মনের জিজ্ঞাসা৷ আলোচনা নিয়ে গেলেন আরো গভীরে৷ বললেন আপনাদের পরের ক্লাসের জন্য বাধ্যতামূলক থাকলো ‘গড এব জাস্টিস' নামের বইটি৷ পড়ে আসবেন বলে বিদায় নিলেন সেদিন৷
তাঁর এক ছাত্রীর লেখা বই, পরে যিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেছিলেন৷ সৌভাগ্যক্রমে তিনিও আমার শিক্ষিকা ছিলেন৷
বইটিতে এ শিক্ষিকা দেখিয়েছেন কিভাবে নেপালের হিন্দু জনগোষ্ঠির সুবিধা বঞ্চিত অংশটি সুবিচার পাওয়ার জন্য দেবতার আশ্রয়প্রার্থী হয়৷
প্রিয় পাঠক, এ পর্যন্ত এসে নিশ্চয়ই আপনার মনে হচ্ছে, ‘আধুনিক' যুগে এসে কি সব আজগুবি পড়াশুনা, তাও আবার হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পশ্চিমের নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে৷
হ্যাঁ, এ প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমার প্রিয় শিক্ষককেও৷ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বায়োমেডিক্যাল চিকিৎসকদের এক সম্মেলনে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি৷
কি উত্তর দিলেন আপনি, জানতে চাইলাম৷ বিড় বিড় কি যেন করলেন, আর কিছুটা বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলেন৷
মুহূর্তেই বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনুন্নত দেশগুলোকে উন্নত করার নামে হাতে নেওয়া হয় মডার্নাইজেশন প্রকল্প৷
ভয়াবহ প্রকল্পটি অনুন্নত দেশে বিদ্যমান সংস্কৃতিকে নাকচ করে এই বলে যে, এ ধরনের সামাজিক চর্চা উন্নত হয়ে উঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা৷ আমাদেরকে একটি আধৃনিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে৷ আর এই আধুনিকতার নামেই বিশ্বজুড়ে বাড়ছে অ্যামেরিকানাইজেশন বা ইউরোপীয়ানাইজেশনের হাওয়া৷ অর্থাৎ পশ্চিম থেকে আগত সবকিছুই আমাদের কাছে হয়ে উঠে আধুনিকতার উপষঙ্গ, বললেন তিনি৷
আপনি যে সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে, যে সমাজের মানুষ নিয়ে কাজ করবেন বা করছেন, সে সমাজ কাঠামোর ভেতরে দাঁড়িয়ে আপনাকে কথা বলতে হবে, বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তাঁদেনকে বিচার করতে যাওয়া অনেকটা বোকামি, বলছিলেন এ অধ্যাপক৷
তারও কিছুদিন আগের কথা৷ যে শিক্ষিকার কথে বলছিলাম তাঁর একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করি আমি৷ সিদ্ধান্ত নেই চূড়ান্ত পরীক্ষার অংশ হিসেবে ছোট্ট একটি গবেষণা করে দেখবো যে, কবিরাজি চিকিৎসা সাধারণত সমাজের শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে থাকে৷
আমার শিক্ষিকা এ বিষয়ে খুব একটা দ্বিমত পোষণ করেননি৷ তবে পাশাপাশি আমাকে এও দেখতে বললেন কোন একটি দেশে, সেটি দক্ষিণ এশিয়ার হতে পারে শিক্ষিত, বিত্তশালী হওয়ার পরেও অনেকেই এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন৷
অ্যামেরিকার নিউজউইক ম্যাগাজিনের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশটির ৭১ ভাগ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জানিয়েছেন তারা রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে থাকেন৷ চিলির হাসপাতালের ডাক্তারদের নিয়ে এক গবেষণায় পেয়েছিলাম টেস্টটিউবে ভ্রূণ প্রদানের সময় ডাক্তাররা কতটা সাবলীলভাবেই নিজেদের সামর্থ্যকে সৃষ্টিকর্তার উপর সমর্পণ করে দেন৷
বলছিলাম, প্রফেসররের কথা৷ সাংবাদিকতায় পড়াশোনা শেষে আমি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথ্রোপলজি পড়তে আসি৷ আমার মার্স্টার্স প্রাগ্রামের মেজর ফোকাস ছিল কালচারাল এন্ড মেডিক্যাল অ্যান্থ্রপলজি৷ দক্ষিণ এশিয়া থেকে কয়েক দেশের ডাক্তারও যোগদান করেন আমাদের সাথে৷ পড়াশোনার মূল ফোকাস ছিল স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন সামাজিক ও সাস্কৃতিক দিক নিয়ে গবেষণা করা৷ যেখানে বলা হয়, স্বাস্থ্য শুধু শারীরিক বিষয় নয় এর সাথে জড়িত থাকে ব্যাক্তির মানসিক, অর্থনীতি এবং সামাজিক-সংস্কৃতির বিষয়াদিও৷ এর কোন একটিকে অস্বীকার করে হয়তো সাময়িকভাবে রোগমুক্তি সম্ভব কিন্তু শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কতটা সম্ভব সে প্রশ্নটি থেকে যায়৷ আর তাই বিশ্বের বহু বায়োমেডিক্যাল স্পেশালিস্টেরও পরবর্তীতে মেডিক্যাল এনথ্রোপলজিস্ট হিসেবে ক্যরিয়ার গড়ার ইতিহাস রয়েছে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷