আইএস বন্দি থেকে আইএস শিকারি
১১ আগস্ট ২০১৭কিবোর্ডে আঙুল চলেছে৷ মাসুদের কম্পিউটার ইসলামিক স্টেট বা আইএস সন্ত্রাসীদের সংক্রান্ত তথ্যে ভরা৷ মাসুদ আপাতত কয়েকটি ফেসবুক প্রোফাইলের স্ক্রিনশটের খোঁজ করছেন; এক সম্ভাব্য আইএস সমর্থক ইউরোপে পৌঁছানোর পর তার উগ্রপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মাসুদকে খোলাখুলিভাবে লেখে৷ লোকটিকে মাসুদের সিরিয়া থেকে মনে আছে – কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল উধাও হয়েছে৷ তাই তাঁর নিজের স্টোর করা সেই ফেসবুক প্রোফাইলটির স্ক্রিনশটের সন্ধান করছেন মাসুদ৷
‘‘ওদের অনেকে গোড়ায় কিরকম খোলাখুলি কথা বলেছে, তা বিশ্বাস করা শক্ত’’, ২৪ বছর বয়সি মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন৷ ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে, মাসুদ যখন নিজে বলকান রুট ধরে জার্মানির দিকে পালাচ্ছেন, তখন তিনি হঠাৎ উপলব্ধি করেন যে, তাঁর নিপীড়নকারীরা ইউরোপেও রয়েছে – ইসলামিক স্টেট!
২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মাসুদকে সিরিয়ায় আইএস-এর ছ'টি বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল৷ একটি সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়ার সময় আইএস সদস্যরা মাসুদ ও তাঁর সহযোগী ফরহাদকে একটি চৌরাস্তার মোড়ে গাড়ি থেকে অপহরণ করে৷
তারিখটা ছিল ২০১৪ সালের ১৫ই ডিসেম্বর৷ বস্তুত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার রোজাভায় এই রাস্তার মোড়টি আইএস-এর নয়, বরং কুর্দ গণ সুরক্ষা গোষ্ঠী ওয়াইপিজি-র যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল৷ আইএস-এর অবস্থিতি তখন রোজাভা থেকে অনেক দূরে৷
আইএস-কে কি কেউ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল?
কুর্দ টেলিভিশন সাংবাদিকরা যে ঐ চৌরাস্তা দিয়ে যাবেন, আইএস-এর কাছে সে ব্যাপারে খুব সম্ভবত আগে থেকে খবর ছিল৷ মাসুদ ও তাঁর সহযোগী ফরহাদ হামো আইএস-এর কাছে পুরোপুরি অপরিচিত ছিলেন না৷ এর আগের ২০ মাস ধরে তাঁরা তাঁদের টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্য প্রায় প্রতিদিন রিপোর্ট ফাইল করেছেন: বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় ছাড়া যুদ্ধের প্রগতি সম্পর্কেও রিপোর্ট দিয়েছেন তাঁরা৷
রোজাভার কুর্দ নেতৃত্ব তখন এলাকাটিতে স্থিতি আনার কাজে ব্যস্ত – ওয়াইপিজি তখন আইএস-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈরী হিসেবে নাম করছে ও তারাই ছিল তখন সিরীয় সংঘাতে সংশ্লিষ্ট একমাত্র গোষ্ঠী, যারা বাইরে থেকে সাহায্য পাচ্ছিল, কেননা প্রতিবেশি তুরস্ক থেকে পিকেকে গোষ্ঠী তাদের মদত দিচ্ছিল৷ আজ রোজাভার ওয়াইপিজি যোদ্ধারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস বিরোধী জোটের অঙ্গ ও তারা ইসলামিক স্টেট সম্বন্ধে যা জানে, তা অতি মূল্যবান তথ্য৷
ইসলামিক স্টেট বিশেষ করে সিরিয়ার পিছনে-পড়ে-থাকা মানুষদের সমর্থন সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, বলেন মাসুদ: ‘‘আইএস-এর এলাকার মানুষজন প্রধানত মরু অঞ্চলে বাস করতেন, যেখানে স্কুল-কলেজ বলে কিছু ছিল না৷ সিরীয় সরকার তাদের স্রেফ উপেক্ষা করছিল৷ কাজেই এই সব মানুষ বিনা জীবিকায় সেখানে আটকা পড়ে ছিল৷ এ ধরনের মানুষ উগ্রপন্থি আদর্শে চট করে আকৃষ্ট হন৷ আইএস সেটা জানত ও সে প্রবণতার সুযোগ নিতে পেরেছিল৷’’
এই পরিস্থিতিতে তরুণ ভিডিও সাংবাদিক মাসুদ ও তাঁর সহযোগীকে জিম্মি করে আইএস, ও জিম্মিদের উপর শারীরিক নিপীড়ন চালায়৷ মাসুদ সে অত্যাচারের কথা বললেন: ‘‘ওরা আমাকে নিপীড়ন করার সময় জেরা চালিয়েছে৷ আমার পায়ে ও পিঠে আঘাত করেছে৷ ওরা আমার মুখে ঘুঁষি মেরেছে, চুল টেনেছে, কুর্দ কাফের বলে আমাকে গাল দিয়েছে – বলেছে যে, সব কুর্দকে মেরে ফেলা উচিত, আমাদের সবাইকে, কেননা আমরা এলাকাটিকে ইসলামপন্থিদের ধারণা অনুযায়ী ইসলামি হতে দিচ্ছি না৷’’
মাসুদ যখন সিরিয়ায় আইএস-এর দ্বিতীয় কারাগার আল-শাদ্দাদিতে পৌঁছান, তখন তাঁর জন্য রীতিমতো একটি অ্যাডমিশন ফর্ম ভর্তি করেন টিউনিশিয়া থেকে আসা এক আইএস সদস্য, যেন আইএস সত্যিই একটি ‘স্টেট’ বা রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে: ‘‘আইএস-এর কারাগারে আইএস-এর আইডি-র মতো,’’ বলেন মাসুদ৷
হামবড়াই
আইএস-এর সদস্যরা ভুলও করেছে: ‘‘ওরা আমার কাছে ওদের চর পাঠিয়ে ওদের সংগঠনের ক্ষমতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে'', বলেন মাসুদ৷ ‘‘ওরা আমাকে আইএস-এর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সম্পর্কে খবরের কাগজের প্রবন্ধ আর পশ্চিমি মিডিয়ার ভিডিও দেখিয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে ওরা খুব গর্বিত ছিল৷’’
হয়ত একটু বেশি গর্বিত ছিল, বলে মাসুদের ধারণা৷ শেষমেষ মৃত্যু অবধারিত, বলে ধরে নিয়ে যে সব আইএস চর মাসুদের কারাকক্ষে এসেছে, তারা খোলাখুলিভাবে তাদের করা হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছে৷ মাসুদকে তারা এমন অনেক খুঁটিনাটি জানিয়েছে যা মাসুদ আজ অবধি ভোলেননি৷ ‘‘আমার তথ্যের একটা উৎস হলো আমি আইএস-এর কারাগারে যা শুনেছি৷ এছাড়া বিভিন্ন আইএস সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তি, যারা অন্যান্য আইএস যোদ্ধাদের কথা জানত৷ ২০১৫ আর ২০১৬ সালে যে সব সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও সম্ভাব্য সন্ত্রাসী জার্মানিতে পালিয়ে এসেছে, তাদের খুঁজে বার করতে এই তথ্য আমাকে সাহায্য করেছে,’’ বলে মাসুদ আজ মনে করেন৷
আইএস-এর বিভিন্ন নিপীড়ন কক্ষে মোট ২৮০ দিন কাটানোর পর মাসুদ একটি বন্দিবিনিময় কর্মসূচিতে মুক্তি পান ও সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে পলায়ন করেন৷
জার্মান সরকারকে তথ্য প্রদান
কাজেই মাসুদ যখন জার্মানিতে আসেন, তখন তিনি বিশদ তথ্য সঙ্গে করে নিয়ে আসেন – সে তথ্য এমনই বিশদ যে, বিশেষজ্ঞরা মাসুদের বিবরণকে বিশেষভাবে বিশ্বাসযোগ্য বলে গণ্য করেন৷
মাসুদের অভিজ্ঞতা যেন তাঁর স্মৃতিশক্তিকে আরো প্রখর করেছে৷ বার্লিনের সাংবাদিক পেটার ক্যোফ-এর সঙ্গে যৌথভাবে একটি বই লিখেছেন মাসুদ, যা এ-মাসেই প্রকাশিত হচ্ছে৷ বইটিতে মাসুদ আকিল ব্যাখ্যা করেছেন, কেন তিনি তাঁর পরিচয় গোপন করছেন না এবং কেন তিনি আইএস-এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধের পন্থা বেছে নিয়েছেন: ‘‘আমি চাই না যে, এই দানবগুলো এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করুক যেখানে জার্মানিতেও জঙ্গলের আইন চালু হবে৷ কাজেই আমি যা কিছু জানি, আমার সব তথ্য জার্মান কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’’
সেই তথ্য আজ জার্মান পুলিশকে চলতি নানা তদন্তে সাহায্য করছে৷ দৃশ্যত জার্মান দায়রা পুলিশ দপ্তর (বিকেএ) অবশেষে উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে পাওয়া হুঁশিয়ারি ও খোঁজখবরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, অতীতে যা ঘটেনি৷ মাসুদ আকিল স্বয়ং বলেছেন যে তিনি জার্মানিতে আসার পর কেন যে তাঁকে ঠিকমতো জেরা করা হয়নি, তা তিনি আজও বুঝে উঠতে পারেননি৷
ফ্রাংক হফমান/এসি