আগামী বছর থেকে ইউরোপে বিমান চলাচলের উপর নতুন মাশুল
১৪ অক্টোবর ২০১১নির্গমন নিয়ে বৈধ ব্যবসা
জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার ক্ষেত্রে কার্বন নির্গমনের ভূমিকা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই৷ প্রতিটি দেশই নির্গমন কমাতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা মেনে চললে সার্বিক লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো অসম্ভব নয়, যদিও তার পদে পদে রয়েছে নানা বাধা৷ তবে শুরু থেকেই এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এমন একটা ফাঁক রাখা হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করতে কার্পণ্য করছে না অনেক দেশ৷ ‘এমিশন ট্রেড' বা নির্গমন সংক্রান্ত বাণিজ্যের এই কাঠামোর আওতায় কোনো শিল্পোন্নত দেশ নিজেদের ‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত' করতে কোনো উন্নয়নশীল দেশকে বলতে পারে, ‘‘তোমাদের জন্য নির্গমনের যে উর্দ্ধসীমা স্থির করা হয়েছে, তা তোমাদের প্রয়োজন হবে না, কারণ বাস্তবে তোমাদের নির্গমন অনেক কম৷ তোমাদের সেই পুণ্যের কিছুটা আমাদের দাও, আমরা তার বদলে তোমাদের কিছু টাকা দেবো৷'' এই বোঝাপড়ার মাধ্যমে শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজেদের নির্গমনের উর্দ্ধসীমায় পরিবর্তন আনতে পারে৷
বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে ‘এমিশন ট্রেড'
দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ‘এমিশন ট্রেড'এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে৷ শিল্প সংস্থাগুলিও নিজেদের মধ্যে এমন দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে পাপ-পুণ্য ভাগাভাগি করে নিতে পারে৷ কিন্তু সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকার নির্গমনের অন্যান্য উৎসের দিকেও নজর দিচ্ছে৷ যেমন বেসামরিক বিমান চলাচল ক্ষেত্রও কার্বন নির্গমনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য দায়ী৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১২ সাল থেকে এই ক্ষেত্রকেও ‘এমিশন ট্রেড'এর আওতায় আনতে চায়৷ শুধু ইউরোপীয় বিমান সংস্থাই নয়, যেসব সংস্থার বিমান ইউরোপে যাতায়াত করে, তাদেরও এই কাঠামোর মধ্যে আনার লক্ষ্য স্থির করেছে ইইউ৷
জোরালো প্রতিরোধ
তবে বিতর্কিত এই ‘একলা চলো রে' নীতির পরিণাম ইউরোপের জন্য বেশ ক্ষতিকারক হতে পারে৷ যেমন চীনের কথাই ধরা যাক৷ সেদেশের কোনো বিমান সংস্থাকে শুধু ইউরোপে উড়ানের জন্য বাড়তি মাশুল গুনতে হলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে৷ এয়ারবাস সংস্থার কাছে নতুন বিমানের অর্ডার বাতিল করে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে৷ চলতি বছরেই বেইজিং এই হুমকি দিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বিষয়টিকে আদালতে নিয়ে গেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে বাড়তি মাশুলের বিরুদ্ধে মার্কিন কোম্পানিগুলি ইউরোপীয় আদালতে অভিযোগ জানিয়েছে৷ বিমান সংস্থাগুলির আশঙ্কা ‘এমিশন ট্রেড'এর কাঠামোয় তাদের অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হবে৷ এমন আশঙ্কা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক নয় বলে মনে করেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের জার্মান সাংসদ পেটার লিজে৷ তিনি বললেন, ‘‘বাড়তি আর্থিক ব্যয়ের মাত্রা আসলে খুবই কম৷ ইউরোপীয় কমিশনের হিসেব অনুযায়ী নিউ ইয়র্ক থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টগামী উড়ানে যাত্রী প্রতি মাত্র ২ ইউরো বাড়তি মাশুল গুনতে হবে৷''
বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়
নতুন এই নিয়ম অনেক আগেই আইনি বৈধতা পেয়েছে৷ ইইউ'র সদস্য দেশগুলি এই নিয়ম মেনেও নিয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে এই বিধিনিয়ম প্রয়োগ করতে গিয়ে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে৷ প্রশ্ন উঠছে, নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাকিদের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া আদৌ উচিত হবে কি না৷ জার্মানির সরকার শুরু থেকেই একটি বিষয়ে অনড় ছিল৷ তাদের বক্তব্য, শুধু ইউরোপের বিমান সংস্থাগুলিকে এই নিয়মের আওতায় এনে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বৈষম্য আনলে চলবে না৷ বাকিদেরও এই নিয়ম মেনে চলতে হবে৷ ইউরোপীয় কমিশনও সেই পথেই এগোচ্ছে৷ তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এবিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে, যার লক্ষ্য বোঝাপড়ার মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব দেশকে নতুন নিয়মের আওতায় আনা৷ বলাই বাহুল্য, বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর৷ ইউরোপ দাদাগিরি করছে, এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হলে অগ্রগতি থেমে যাবে৷ ফলে নরম সুরে নতুন নিয়ম কার্যকর করার খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে৷ এমনকি বেশ কিছু বিমান সংস্থা নাকি বলছে, শুধু ইউরোপের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ না রেখে গোটা বিশ্বে একক নিয়ম চালু করা উচিত৷
বিপল্প পথ
বিশ্বের অন্যান্য অনেক প্রান্তেও কার্বন নির্গমন কমাতে ভাবনা চিন্তা চলছে৷ যেমন চীন ‘এমিশন ট্রেড'এর বদলে নিজস্ব যাত্রী বিমানগুলির নির্গমনের মাত্রা ২২ শতাংশ কমানোর কথা ঘোষণা করেছে৷ কীভাবে এটা সম্ভব হবে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়৷ ইউরোপীয় কমিশনও এই প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখছে যে চীন যদি সত্যিই প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে নির্গমন কমাতে পারে, সেক্ষেত্রে ইউরোপের আকাশে সেদেশের বিমানগুলিকে আর বাড়তি মাশুল গুনতে হবে না৷ মোটকথা আলোচনা জোরকদমে এগোচ্ছে৷ তবে হাতে বেশি সময় নেই৷ আগামী ১লা জানুয়ারির মধ্যেই বোঝাপড়া চূড়ান্ত করতে হবে৷ অ্যামেরিকা, চীন ও ভারতের মতো দেশ প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে৷ পেটার লিজে এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘চীন ও অ্যামেরিকার হুমকির মুখে নতি স্বীকার করলে আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইউরোপের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবো না৷''
তবে যতই আলোচনা চলুক না কেন, বিমান সংস্থাগুলি নতুন ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে৷ তারা এখনই কমিশনের কাছে নিয়মিত জ্বালানির ব্যবহার ও নির্গমন সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করতে শুরু করে দিয়েছে, যাতে সেই তথ্যের ভিত্তিতে মাশুলের সঠিক হিসেব করা সম্ভব হয়৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক