আগে দুইবার করোনা নেগেটিভ, মৃত্যুর পর পজিটিভ
১৫ মে ২০২০বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান৷
তার চিকিৎসা পরামর্শক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে করোনা সংক্রান্ত এই তথ্য জানা গেছে৷
শেষ পর্যন্ত করোনা পজিটিভ হওয়ায় তাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন মেনে শুক্রবার সকালে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়৷
দাফনের আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়৷ জানাজায় পরিবারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান, ভাই আখতারুজ্জামান ও মেয়ে জামাই আজিমুল হক উপস্থিত ছিলেন৷ সকাল পৌনে ১১ টার দিকে দাফনের কাজ শেষ হয়৷
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘১০ মে একবার বাবার করোনা টেস্ট হয়েছিল সিএমএইচ-এ৷ তখন নেগেটিভ আসে৷ কিন্তু আবারো টেস্ট করা হলে মৃত্যুর পর জানা যায় তার করোনা পজিটিভ৷’’
তিনি জানান, ‘‘শুক্রবার ভোরে জ্বর আসার পর করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল নেয়া হয়৷ কিন্তু রেজাল্ট আসার আগেই তিনি মারা যান৷ মারা যাওয়ার পরে রাতেই রিপোর্ট আসে করোনা পজিটিভ ৷’’
এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আনন্দ জামান বলেন, ‘‘তার করোনার সেরকম কোনো সিম্পটমও আগে দেখা যায়নি৷ আর সিএমএইচ-এর আগে তিনি ইউনিভার্সেল মেডিকেলে ছিলেন৷ সেখানে তার করোনা পরীক্ষা করা হয়নি৷’’
করোনা প্রসঙ্গে পরিবারের পক্ষ থেকে আর চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি৷ আনন্দ জামান বলেন, ‘‘এখন আর কথা বলে কী হবে! তিনি তো মারাই গেছেন৷’’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছোটভাই আখতারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আগে কোনো টেস্টেই করোনার কথা জানতে পারিনি৷ তিনি মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বলা হলো করোনা টেস্ট করা হবে৷ রেজাল্ট পেতে সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগবে৷ তার আগে লাশ দেয়া যাবে না৷ রেজাল্টে তার করোনা পজিটিভ জানানো হয়৷’’ তবে তিনি আরো জানান, ‘‘তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল৷ চিকিৎসকরা বলছিলেন তার ওপর ওষুধ তেমন কাজ করছে না৷’’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর৷ ২৭ এপ্রিল এই শিক্ষাবিদকে ঢাকার ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ তাঁর হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপ, পারকিনসন ডিজিজসহ নানা শারীরিক জটিলতা ছিল৷
৯ মে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে তাকে সিএমএইচ-এ স্থানান্তর করা হয়৷ উভয় হাসপাতালেই তার চিকিৎসার ব্যাপারের নিয়মিত পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিএমএইচ-এ নেয়ার পর ৯ মে তার প্রথম করোনা টেস্ট করা হয়৷ এরপর ১০ মে আবার টেস্ট করা হয়৷ দুইবারই করোনা নেগেটিভ আসে৷ তার করোনার সিম্পটমও ছিলোনা৷ তবে মৃত্যুর পর টেস্টে করোনা পজিটিভ আসে৷’’
আর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের এখানে স্যার ২৭ এপ্রিল থেকে ৯ মে সকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ তখন আমরা তার কোনো করোনা টেস্ট করিনি৷ কারণ, তার মধ্যে আমরা করোনার উপসর্গ দেখিনি৷’’
‘মৃত্যুর মূল কারণ হার্ট অ্যাটাক'
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘ইউনিভার্সেল মেডিকেল এবং সিএমএইচে চিকিৎসকরা তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমার সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করেছেন৷ তিনি নানা ধরণের জটিল রোগে ভুগছিলেন৷ হার্ট, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, প্রেসার, কিডনি সমস্যা ছিল৷ তার পিঠের কাছে কয়েকটা হাড়ও ভাঙা ছিল৷’’
দুইবার নেগেটিভ আসার পর পজিটিভ আসার কারণ কীহতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা স্যাম্পল কালেকশনের ওপর নির্ভর করে৷ অথবা তার করোনা সংক্রমণ পরেও হতে পারে, আগে হয়তো ছিল না৷ সিএমএইচ-এ তো অনেক করোনা রোগী আছে৷ তবে তার মৃত্যুর মূল কারণ হার্ট অ্যাটাক৷’’
বিষয়টি নিয়ে সিএমএইচ-এর সঙ্গে কথা বলা যায়নি৷ আইএসপিআর জানিয়েছে, ‘তার পরিবার যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে সেটাই৷ সিএমএইচ আলাদা কোনো স্টেটমেন্ট দেবে না৷’’
‘আগে নেগেটিভ, পরে পজিটিভ হতে পারে'
আইইডিসিআর-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘‘করোনা নেগেটিভ আসা মানে এই নয় যে, তিনি করোনামুক্ত৷ উপসর্গ ডেভেলপ করার আগে টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসার সম্ভাবনা অনেক কম৷ সর্বোাচ্চ দুইদিন আগে পজিটিভ আসতে পারে৷ যখন পরীক্ষা করা হয়েছে তখন ধরা না পড়লেও পরে ধরা পরতে পারে৷ আর তিনি হাসপাতালে ছিলেন, তার কাছে আত্মীয়-স্বজন গেছেন, চিকিৎসায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে৷ যে কোনো সূত্র থেকে তিনি ইনফেকটেড হতে পারেন৷ হাসপতালে করোনা সংক্রমণের নানা সূত্র থাকতে পরে৷ যেদিন তিনি মারা গেছেন. সেদিন সকাল থেকে তার জ¦র ছিল৷ তখন সিম্পটম দেখা গেছে৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘করোনা পরীক্ষার স্যাম্পলেও ত্রুটি থাকতে পারে৷ স্যাম্পল কালেকশন, সংরক্ষণ বা পরিবহণে কোনো ত্রুটি থাকলেও সঠিক ফল না-ও আসতে পারে৷ যেমন গলা বা নাকের ঠিক যে জায়গা থেকে স্যাম্পল নেয়ার কথা সেখান থেকে যদি না নেয়া হয়৷ এটা অনুমান করে বলছি৷ কিন্তু সিএমএইচে এটা হওয়ার কথা নয়৷ কারণ, সেখানে প্রশিক্ষিত লোকজন কাজ করেন৷’’
তার মতে, ‘‘ যারা এটা নিয়ে কাজ করেছেন. তারা, ভাইরোলেজিস্টদের সাথে মিলে রিপোর্ট অ্যানালাইসিস করে হয়তো সঠিক তথ্য দিতে পারেন৷’’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পরিবার৷ তাঁর ছোটভাই আখতারুজ্জামান জানান, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিকভাবে তার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিয়েছেন৷ যা করা প্রয়োজন, সব উদ্যোগ নিয়েছেন৷ আমরা তাঁর কাছে ঋণী৷ শুধু দুঃখ একটাই করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে তার দাফন করতে পারলাম না৷ সবাই মিলে তাকে শেষ বিদায় জানাতে পারলাম না৷’’